বিশেষ খবররাজনীতি

ছাত্রলীগে ক্ষুণ্ন হচ্ছে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি

ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকারের অর্জন। ক্ষুণ্ন হচ্ছে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি। কমিটি বাণিজ্য, পদ-পদবি, হল দখল, সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি নিয়ে চলছে নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি। অভিযোগ রয়েছে সংগঠনে অনুপ্রবেশ ঘটানোরও। ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনার পারদ যেন আকাশ ছুঁয়েছে। বিভিন্ন ইউনিটের নেতা-কর্মীরা নানা অপকর্মে জড়িয়ে খারাপ খবরের শিরোনাম হচ্ছেন। ছাত্রলীগকে বিতর্কিত করার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের টানা উন্নয়ন-অর্জন ধূলিসাৎ হচ্ছে এসব কাণ্ডে। এ পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগ আজ কাঠগড়ায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ছাত্রলীগের সাবেক শীর্ষ নেতারা বলছেন, সঠিক তদন্তের মাধ্যমে ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। লাগাম টেনে ধরতে হবে অপকর্মকারীদের। তা না হলে সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর মাশুল দিতে হবে আওয়ামী লীগকে। কারণ ছাত্রলীগের অপকর্মের ফিরিস্তি বিরোধীরা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে। এ সুযোগ বিরোধী পক্ষকে দেওয়া ঠিক হবে না। সেজন্য সর্বনাশ ঘটার আগেই শক্ত হাতে ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরতে হবে।

এ প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্না বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ছাত্রলীগের নেতৃত্বে দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সম্প্রতি ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ শোনা যায়, তা খুবই অশনিসংকেত। বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান থাকবে- কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তদন্ত করতে হবে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পকেট কমিটি গঠন, মাইম্যান সৃষ্টি করা যাবে না। অনুপ্রবেশ যেন না ঘটে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণকারী পরিবার থেকে নেতৃত্ব তুলে আনতে হবে। না হলে শুধু ছাত্রলীগ নয়, আওয়ামী লীগের অর্জন-উন্নয়ন ম্লান হবে।’

সূত্রমতে, বর্তমানে চরম অস্থিরতা চলছে ছাত্রলীগে। কেন্দ্রের শীর্ষ নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতায় ক্ষুব্ধ কমিটির অনেক নেতা। এ ছাড়া ঠিকমতো মূল্যায়ন না পাওয়ায় কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক নেতাই নিষ্ক্রিয়। ক্ষোভ আর অভিমানে অনেকে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে তেমন তৎপর নন। আবার কেউ কেউ ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন সাংগঠনিক ফোরাম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কেউ কেউ একে অন্যের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনছেন।
সংগঠনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশ কিছু কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গঠনতন্ত্র না মানা, নেতাদের মূল্যায়ন না করা, কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও সম্মেলনের প্রস্তুতি না নেওয়া, বিভিন্ন ইউনিটে নিজেদের এলাকার প্রার্থীদের শীর্ষ পদে বসানোর প্রবণতা, কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঢালাওভাবে পদ দেওয়া, ফেসবুক-কেন্দ্রিক রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়া, নেতাদের বিলাসী জীবন, ক্ষোভ প্রশমনে উদ্যোগী না হওয়া, টেন্ডার বা অন্য আর্থিক বিষয়গুলোয় ভাগ না পাওয়া।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক ফোরামের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের এখন সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার নাম ছাত্রলীগ। ঐতিহ্যবাহী এ ছাত্র সংগঠন এখন একের পর এক বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে। শনিবার রাতে ইডেন মহিলা কলেজে সিট বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ছাত্রলীগের অন্তঃকোন্দল প্রকাশ্য রূপ ধারণ করে। ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের পর থেকেই ক্যাম্পাসজুড়ে অস্থিরতা চলছে। আধিপত্য, হল দখলসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে নতুন নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া হলের ছাত্রীদের কটূক্তি ও অশালীন বক্তব্যও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। শুধু অশালীন বক্তব্যই নয়, নিজেদের মধ্যে চুলোচুলি ও সংঘর্ষে লিপ্ত হন ইডেন ছাত্রলীগ নেত্রীরা। ইডেন কলেজের এক ছাত্রলীগ নেত্রী নয়টি হল দখলে রেখেছেন। নতুন নেতৃত্ব আসার পর তাকে একটি হল রেখে অন্যগুলো ছাড়তে বলা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হন ওই নেত্রী। এরপর ইডেনে বিতর্কের ঝড় শুরু হয়। শুধু ইডেন কলেজ নয়, দেশজুড়ে প্রায় সব জায়গায় এক ধরনের অস্থিরতা দেখা যায় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের মধ্যে।

চলতি বছর শোক দিবসে বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর উপস্থিতিতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ ঘটে। ঘোষিত কমিটি নিয়েও কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আর্থিক লেনদেনের বিস্তর অভিযোগ। সম্প্রতি গঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে পদ না পেয়ে বঞ্চিত নেতারা অবরোধ ডাকেন, টায়ার জ্বালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে তালা লাগিয়ে দেন। গত বছর সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি দেওয়া হয়। ওই কমিটিতে অছাত্র-ফ্রীডম পার্টি করা এক নেতার নাতিকে স্থান দেওয়ার অভিযোগ করেন স্থানীয় ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক নেতারা। গত বছরের ১৩ অক্টোবর সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদ সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উভয়ে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে অছাত্র, দেশজুড়ে আলোচিত সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণ মামলার আসামিদের গডফাদার, বিভিন্ন চেক ডিজওনার মামলার আসামি, বিশেষ করে ফ্রীডম পার্টির নেতার নাতিকে নিয়ে সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এতে আমরা সিলেট ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা লজ্জিত, চরম হতাশ ও বিব্রত। আমরা ঘোষিত এ কমিটি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি।’

রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সাকিবুল ইসলাম রানা ২০১৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি গঠিত রাজশাহী কলেজ মুসলিম হল ছাত্রদলের কমিটিতে ৬ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। এর আগে তিনি ছাত্রশিবির করতেন। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রানা জেলা ছাত্রলীগের পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। তার ছাত্রশিবির ও ছাত্রদল করার কথা ইতিমধ্যে ফলাও করে গণমাধ্যমে এসেছে। অভিযোগ আছে, ছাত্রলীগ সভাপতি জয়ের মায়ের আবদার রক্ষা করতে গিয়ে ছাত্রশিবির করা রানা জেলা ছাত্রলীগ সভাপতির পদ পেয়েছেন। এ ছাড়া জেলা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন অমির মাদক গ্রহণের দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

৩১ জুলাই রাতে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি দেওয়া হয়। এতে সভাপতি হন ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত, সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয়। এ আরাফাতের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসির নিচতলায় অবস্থিত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় ওই বছরের ৩০ মার্চ তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন তাকে বহিষ্কার করেন। এ ছাড়া ২০১৮ সালের ২২ জানুয়ারি মাদকসহ গ্রেফতার হওয়া আসামিকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এমনকি ইবি ছাত্রলীগ সভাপতি হওয়ার আগেই আরাফাতের বিরুদ্ধে পুরো ক্যাম্পাসে মাদকের রমরমা ব্যবসার খবর দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

অন্যদিকে বর্তমান কমিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে গঠনতন্ত্র না মানার। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি দুই মাস অন্তর নির্বাহী সংসদের সভা হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমান কমিটি মাত্র একটি সাধারণ সভা করেছে। এ ছাড়া কাউন্সিলর, কেন্দ্রীয় কমিটি, সম্পাদকমণ্ডলীর সভা হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। গঠনতন্ত্রে কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ ৩০১ সদস্য নিয়ে গঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে এ সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। গঠনতন্ত্রের এ সিদ্ধান্তটিও মানা হয় না দীর্ঘদিন। অন্য কোনো নেতার সঙ্গে আলোচনা না করেই তারা ‘জরুরি সিদ্ধান্ত মোতাবেক’ লিখে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।

ঢালাওভাবে কেন্দ্রীয় কমিটিতে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক তাদের ইচ্ছামতো পদ দেওয়ায় অন্য নেতারা ক্ষুব্ধ। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদ দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতার মতামত তারা নেননি। বর্ধিত সভায় সেটি অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার কথা থাকলেও করেননি। অনেক ছাত্রলীগ নেতাই দাবি করছেন, সংগঠনের বিভিন্ন কমিটিতে অনেক অনুপ্রবেশকারী রয়েছেন। তারা বিভিন্ন উপায়ে সংগঠনে ঢুকে বদনাম করছেন। তাদের উদ্দেশ্য ছাত্রলীগকে বিতর্কিত করা।

ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধেও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। তাদের ওপর তৃণমূল নেতা-কর্মীর আস্থা নেই বলে জানিয়েছেন অনেক ত্যাগী-পরীক্ষিত ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী। কমিটি বাণিজ্য, ধর্ষণ, খুন, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধকর্মের অভিযোগে এখন জর্জরিত ছাত্রলীগ। যদিও কেন্দ্রীয় এই নেতৃবৃন্দ বরাবরের মতোই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।

এ প্রসঙ্গে ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বলেন, ‘যেখানেই কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে, সেখানেই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ছাত্রলীগে কোনো অনুপ্রবেশকারীর স্থান নেই।’ কমিটি বাণিজ্য প্রসঙ্গে বলেন, ‘কেউ প্রমাণ দিতে পারলে দায়িত্ব ছেড়ে দেব। একটি জেলা বা ইউনিটিতে কমিটি করতে হলে সেখানকার আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা, এমপি-মন্ত্রীদের মতামত গ্রহণ করা হয়। বিভিন্ন সংস্থা থেকে রিপোর্ট নিয়েই নেতা বানানো হয়। মাইম্যান তৈরি করি না।’ জয়ের দাবি, ছাত্রলীগের একটি ইউনিটে দুটি শীর্ষ পদ থাকে। কিন্তু পদ পাওয়ার মতো যোগ্য নেতা থাকেন অনেক। সবাইকে খুশি করা যায় না। যারা পদ পান না তারাই নানা অভিযোগ রটান।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button