চট্টগ্রামশীর্ষ নিউজ

কর্ণফুলীতে হেরেছে আনারস কিন্তু নৈপথ্য যা ছিল?

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:
চট্টগ্রাম কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে ১ হাজার ২২ ভোটে হেরেছেন স্বতন্ত্রপ্রার্থী মোহাম্মদ আলী। এ হারের পেছনে প্রধান কারণ ছিল-যারা আনারস প্রতীক নিয়ে আলীকে মাঠে নামিয়েছিলেন তাঁরাই সুযোগ বুঝে বোল পাল্টিয়ে গেলেন। ভোটের তিন দিন আগে চার ইউপি চেয়ারম্যানের অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর নিষ্ক্রিয়তায় কে দায়ী করেছেন অনেক নেতাকর্মী।
ভোটের পর সাধারণ মানুষেরা বলছেন, প্রথমে নৌকার পরাজয়ের পথ তৈরি করার স্বপ্ন দেখালেও মূলত চার চেয়ারম্যানের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফসল আনারসের পরাজয়। যেখানে গুটিকয়েক নেতার উপর ভরসা করে সুপরিকল্পিত ছক কষে বিজয়ী হলেন নৌকার প্রার্থী।
ফলে, আলীর পক্ষে নীরবে বহু উপজেলা আ’লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ পাশে দাঁড়ালেও শেষ সময়ে হোঁছট খেয়েছে আনারস। এর অন্যতম কারণ হলো-ব্যক্তিগত স্বার্থে কিছু চেয়ারম্যান তাঁদের গতি হারালেন। এসব চেয়ারম্যানেরা আবার কুটকৌশলে তাঁদের ব্যক্তিগত স্বার্থেই হাসিলে নৌকা ফুটো করার চেষ্টাও করেন। কিন্তু ভোটের শেষ সময়ে এসে নিজেদের বানানো কল্পকাহিনী সাজিয়ে আলীর কান ভারি করে দেন। মুঠােফোনে জানান ভিন্ন তথ্য।
আর সুচতুর চেয়ারম্যানেরা মাঠ ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যান। তাঁদের কর্মীদেরও দেখা মিলেনি ভোটের মাঠে। ফোনেও পাওয়া যায়নি চেয়ারম্যানদের। ফলে, নৌকা ঠকাতে ব্যর্থ হয়েছে তাঁরা।’
কী ধরনের কোন্দল আছে-জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশে আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘এখানে উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও যুবলীগ নেতাদের মধ্যে প্রকাশ্যে ও পরোক্ষভাবে গ্রুপিং আছে। উপরে সবাই সবার জানপ্রাণ কিন্তু ভেতরে অন্তঃসারশূণ্য।’
কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কর্ণফুলীতে আনারস হারার পেছনে অন্যতম কারণ বড়উঠান আর শিকলবাহা। যে প্রতিশ্রুতিতে চেয়ারম্যানেরা ১৫ হাজার লোকের সমাগমে শোডাউন দিলেন সে সব কর্মীরাও ভোট দিতে কেন্দ্রে যায়নি। কারণ তাঁদের নেতাদের আত্মগোপন আর লুকোচুরিতে কর্মীরাও মাঠ ছেড়ে হতাশ।
অন্যদিকে, মন্ত্রীর জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে নৌকার কর্মীরা ছিলেন উৎফুল্ল। পাশে ছিলো বিভিন্ন উপজেলার বহিরাগতরাও। ককটলে ফুটিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখানোর ফলে, সাধারণ ভোটাররাও ঘর থেকে বের হয়নি। এসব কারণে সহজে বিজয় নিয়ে ঘরে ফিরে ফারুক চৌধুরী’র নৌকা।’
যদিও সাধারণ মানুষের একাংশ ভেবেছে এই কর্ণফুলীতে ভূমিমন্ত্রী অভাবনীয় উন্নয়ন করেছেন, তার প্রতিদান হিসেবে নৌকার বাহিরে কাউকে চেয়ারে বসাতে তাঁরা রাজি ছিলেন না। এটিও একটি বাস্তবতা। সব মিলিয়ে কৌশলের কাছে আনারসের হার। পরাজয়ের তীলক বসাতে দুই চেয়ারম্যানেই দায়ী।
বিশ্বস্ত সূত্র আরও বলছে, মোহাম্মদ আলী প্রথমে ভালো অবস্থানে থাকলেও ঢাকা থেকে ফিরে ৪ ইউপি চেয়ারম্যানেরা বোল পাল্টিয়ে ফেলেন। ফোনেও ধরা দেয়নি আলীকে। আনারস প্রার্থী দিনে ২৪ বার তাঁদের কল করলেও পেয়েছেন একবার। তাতেও নানা বাহনায় কৌশল নিয়েছেন।
অনেকে চাপে আপোষ করেছেন আর সুযোগ লুফে নিয়েছেন ৫০ কোটি দামের জমির কাজও। রয়েছে ভুয়া নম্বর থেকে সচিব পরিচয়ে টিএন্ডটি নম্বরের কল। যার পিছনে ঢাকা গেল মোটা অঙ্ক। তদবির বাণিজ্য আর দর কষাকষি করতে করতে মাঠে ছিলেন না ওই চেয়ারম্যানেরা।
তবুও প্রতিকেন্দ্র এজন্টে বসানো ও নানা কাজের বাহনায় বিশাল অঙ্কের সুবিধা নিয়েছেন তাঁরা। সে অনুযায়ি এজেন্টও ভোট কেন্দ্রে ছিলো না আনারসের। তবুও হাড্ডাহাড্ডি লড়েছেন।
চরপাথরঘাটার এলাকার ভোটার ইদ্রিস ও মোরশেদ বলেন, ‘মোটা টাকার কাছে নীতি-আদর্শ মুখ থুবড়ে পড়েছে। আনারসকে হারতে হয়েছে কিছু অর্থ আর স্বার্থলোভী মানুষের জন্য। যারা আলী চেয়ারম্যানকে মাঠে নামালেন তারাই ভোট দেয়নি। তাঁরা হারালেন।
এতে আবার রহস্যজনক ভূমিকায় ছিলেন চরপাথরঘাটার চেয়ারম্যান হাজী ছাবের আহমদ। চরলক্ষ্যা, চরপাথরঘাটা এগিয়ে থাকলেও শিকলবাহা বড় ইউনিয়ন হলেও মাত্র ১ হাজার ভোটে আনারস এগিয়ে। বড়উঠানে ভরাডুবি আনারস হারের অন্যতম কারণ।
মন্তব্য জানতে চাইলে চরলক্ষ্যার আরেক ভোটার হারুন বলেন, ‘আনারস হারের অন্যতম কারণ শেষের তিন দিন চার ইউপি চেয়ারম্যানের  নিষ্ক্রিয়তা। প্রিসাইডিং ও পোলিং, ভোট কেন্দ্রে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের সাথে আনারসের সমন্বয়হীনতা। বহিরাগত ঠেকাতে ব্যর্থ আলীর কর্মী সমর্থকরা।
ম্যাজিস্ট্রেটরা তৎপর ছিলেন বলে কেন্দ্র দখল করতে পারেনি। কিন্তু বাহিরে ছিল প্রচুর বহিরাগত। অন্যদিকে, ভোট কেন্দ্রে ভোটারের অনুপস্থিত। ভোটার টানতে পারেননি আলী। জনবল কম। পাশাপাশি স্থানীয় উপজেলা নির্বাচন অফিসও ছিলো নৌকার কর্মী সমর্থকদের দখলে। সামগ্রিক ভাবে পুরাই কোণঠাসা আলী ওই সব বোল পাল্টানো চেয়ারম্যানের কারণে।
পরাজিত আনারস প্রার্থী মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমার কর্মী সমর্থক ও জনসাধারণের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমাকে যে পরিমাণ ভোট দিয়েছেন তাতেই আমি খুশি। আমার এজেন্ট ছিল না কোথাও। সব বের করে দিলেন। রাস্তায় মারধর করলেন। ককটেল ফোটালেন। সাধারণ মানুষকে ভোট কেন্দ্রে যেতে দেয়নি। এসব কে সুষ্ঠু নির্বাচন বলা যায় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার নেতা কর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। আমার চেষ্টাও কমতি ছিলো না। আমার পরাজয় হয়নি। তবে সুষ্ঠু ভোট গণনা হয়নি। ইভিএম মেশিনের প্রিন্ট কপির ফলাফল পাওয়া যায়নি। নামে ইভিএম হলেও কাজে দেখলাম কলমের লেখা ফলাফল।
উপজেলায় তাদের লোকজন মিলে ফলাফল তৈরি করেছেন। অমুক জিতেছে তমুক জিতেছে বলেছেন।  তবে, কিছু মানুষের মুখোশ সাধারণ জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। এসব কারণেই পরাজয় বলছেন। যদিও এরা প্রভাবশালী। এদের হাতে অনেক ক্ষমতা। তবে আল্লাহ সর্বশক্তিমান। আমি হতাশ হবার লোক নই।’
প্রসঙ্গত, কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী ফারুক চৌধুরী দ্বিতীয়বারের মতো বিজয়ী হয়েছেন। তার মোট প্রাপ্ত ভোট ২১ হাজার ২০। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র পদের মোহাম্মদ আলী আনারস প্রতীকে পেয়েছেন ১৯ হাজার ৯৯৮ ভোট।
ভাইস চেয়ারম্যান পদে আমির আহমদ চশমা প্রতীকে ১৮ হাজার ২৩৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রার্থী মো. মহিউদ্দীন মুরাদ উড়োজাহাজ প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ১৭ হাজার ১৩ ভোট। অপর প্রার্থী আবদুল হালিম তালা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৫ হাজার ৭৯৫ ভোট।
মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ফারহানা মমতাজ ফুটবল প্রতীক নিয়ে ৩৫ হাজার ১৮৪ ভোট পেয়ে সর্বোচ্চ ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বানাজা বেগম হাঁস প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ২ হাজার ৯০০ ভোট।
অপর দুই প্রার্থী মোমেনা আকতার নয়ন কলস প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ২ হাজার ৫৩৫ ভোট ও রানু আকতার বৈদ্যুতিক পাখা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৩৯৫ ভোট।
বুধবার (২ নভেম্বর) রাতে নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ফল ঘোষণা করেন। দ্বিতীয় বারের মতো হওয়া এ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ৫৭৩ জন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button