অর্থ ও বাণিজ্যচট্টগ্রামশীর্ষ নিউজ

১০ বছর যাবৎ ম্যানেজ করেই চলছে মইজ্জ্যারটেকের হাক্কানী খাদ্য কারখানা!

নিজস্ব প্রতিবেদক
চট্টগ্রাম কর্ণফুলীর মইজ্জ্যারটেকে কোনো প্রকার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ১০ বছর ধরেই ঘাটে ঘাটে ম্যানেজ করেই চলছে ‘হাক্কানী কর্পোরেশন লিমিটেড’ নামক একটি খাদ্য কারখানা। অথচ প্রতিষ্ঠানটির নেই পরিবেশ অধিদপ্তর ও মৎস্য বিভাগের লাইসেন্স।
মইজ্জ্যারটেকের ব্যবসায়ি ও স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা কিংবা রাত অবধি কারখানার তীব্র গন্ধে ভারী হয়ে উঠে চরপাথরঘাটা, শিকলবাহা ও চরলক্ষ্যার আশপাশের এলাকা। এতে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে শিশুরাও। এছাড়া এখানকার বর্জ্য যাচ্ছে নালা হয়ে খালে। দূষিত হচ্ছে কর্ণফুলী নদীও।
নুরুল আলম ও জুয়েল নামে দুই ব্যবসায়ি বলেন, ‘মইজ্জ্যারটেক এলাকা হয়ে আসা যাওয়া কালে পাশের মুরগির খাদ্য উৎপাদনকারী কারখানার পঁচা গন্ধে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।’
জানা গেছে, কারখানাটিতে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা অভিযানে সিলগালা করে বন্ধ করলেও পুনরায় চালু করেন হোতারা। মনে হচ্ছে কারখানাটির কাছে বিএসটিআই, পরিবেশ অধিদপ্তর ও উপজেলা প্রশাসনও অসহায়। না হয় কয়েকবার সিলগালা করার পরও কিভাবে চালু করে কারখানাটি। এটাই স্থানীয়দের অভিযোগ।
নিয়মনীতি না মানার অভিযোগ থাকলেও কারখানার লোকজন প্রকাশ্যে বলছেন, সব ম্যানেজ করেই তাঁরা কারাখানাটি চালাচ্ছেন। অথচ পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে পশু খাদ্য উৎপাদন ও কারখানাটি।
তথ্য পাওয়া যায়, ২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর তৎকালিন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ শামসুল তাবরীজ পরিবেশ দূষণের কারণে কারখানাটি সীলগালা করেন। এরপর গত ২০২৩ সালের ১৬ অক্টোবর ওই কারখানায় অভিযান চালান কর্ণফুলী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট পিযুষ কুমার চৌধুরী।
তখন ট্যানারির পঁচা বর্জ্যের সংমিশ্রণে মাছ ও মুরগির খাদ্য উৎপাদন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকায় ১ লাখ টাকা জরিমানা করেন। এর আগে ২০২২ সালের ২১ অক্টোবর একই অপরাধে হাক্কানি কর্পোরেশন লিমিটেড নামক এই প্রতিষ্ঠানকে দুই লক্ষ টাকা জরিমানা করেছিলেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মামুনুর রশিদ।
অথচ, গরু-ছাগল কিংবা হাঁস-মুরগির ফার্ম, খাদ্য তৈরি কারখানা ও এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান তৈরিতে সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। যেখানে এ ধরনের কারখানা লোকালয় থেকে দূরে গড়ে তোলার কথা। কিন্তু একদম ঘনবসতিপূর্ণ লোকালয়ে গড়ে উঠছে এই খাদ্য কারখানা। ফলে, ওইসব এলাকার পরিবেশ মারাত্মক ভাবে দূষিত হচ্ছে। এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবন।
তথ্য মিলে, ২০১৫ সালে কর্ণফুলীর মইজ্যারটেক এলাকায় প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠে। এ কারখানার সামনে কোনো সাইনবোর্ড নেই। আছে জমির মালিক মুছা সওদাগরের সাইন বোর্ড। অতীতে আন্দোলনের মুখে কারাখানাটি তিন মাসের মধ্যে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিলেও মালিকপক্ষ সে কথা রাখেনি। বর্তমানে কারখানাটি আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
কেননা, কারাখানায় ট্যানারি ও বিভিন্ন বাজারের মাছ ও হাঁস-মুরগির উচ্ছিষ্ট দিয়ে মুরগির ফিড তৈরির পাউডার ও তৈল উৎপাদন করা হয়। কারখানার পাশে রয়েছে চরপাথরঘাটা হামিদিয়া বাগদাদিয়া হেফজখানা, এতিমখানা, মাদ্রাসা ও মসজিদ। সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় রয়েছে ওইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্ররা।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে মাদ্রাসার এক শিক্ষক বলেন, ‘মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা ও হেফজখানার দরজা-জানালা ২৪ ঘণ্টা বন্ধ রাখতে হয়। গভীর রাতে এত বেশি দুর্গন্ধ ছড়ায় যে, দম বন্ধ হয়ে আসে।’
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. রুমন তালুকদার বলেন, ‘আমরা যখন গত বছর ওই কারখানাতে অভিযানে করেছিলাম তখন প্রাণি সম্পদ বিভাগ থেকে তাঁদের অনুমোদন ছিলো। কিন্তু এখন তা কার্যকর আছে কিনা জানি না। মেয়াদ আপডেট করেছে কিনা দেখে বলতে পারব। কারখানার বাহিরে দুর্গন্ধ না ছড়ানোর জন্য ইটিপি প্ল্যান বসানোর কথা ছিলো। তাও বসায়নি হয়তো। এ বিষয়ে খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেবো।’
কারখানার পরিচালক শাহ মোহাম্মদ একরাম কে একাধিকবার কল করলেও ফোন রিসিভ না করায় মন্তব্য পাওয়া যায়নি। এমন কি এ বিষয়ে জানতে চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান ছাবের আহমদ কে একাধিকবার কল করা হলেও ফোন রিসিভ না করায় কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক নুর হাসান সজীব জানান, ‘হক্কানী পশু খাদ্য কারখানায় ইতিমধ্যে আমরা অভিযান করেছি। অনেক আগেই তাঁদের পরিবেশ ছাড়পত্র মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। ছাড়পত্র মেয়াদ বৃদ্ধি করার জন্য তারা আবেদন করেছে। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর সার্বিক কার্যক্রমে ও পরিবেশ বিবেচনা করে তাঁদের ছাড়পত্র না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।’
কর্ণফুলী উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট পিযুষ কুমার চৌধুরী জানান, ‘এলাকার মানুষের এসব সমস্যা গুলো নিয়ে উপজেলা মাসিক আইনশৃঙ্খলা সভায় জনপ্রতিনিধিদের আলোচনা করা উচিত। চেয়ারম্যান-মেম্বারদের আরো দায়িত্বশীল হওয়া দরকার। আর এলাকার মানুষের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ওই কারখানায় আমি অভিযান চালিয়ে দুই লাখ করে মোট ৪ লাখ টাকা জরিমানা করেছি। এরপরেও বিষয়টি যেহেতু অভিযোগ আসতেছে খবর নিচ্ছি।’
কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মাসুমা জান্নাত ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ‘বিষয়টি আমি জানি না। খোঁজ খবর নিয়ে জনস্বার্থে আইনি ব্যবস্থা নেব।’

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button