অর্থ ও বাণিজ্যবিশেষ খবর

আইস ইয়াবার অপ্রতিরোধ্য ট্রানজিট মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প

বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার সীমান্তবর্তী থানা উখিয়া। এই থানার পালংখালী ইউনিয়নের সীমান্তঘেঁষা গ্রামের নাম ধামনখালী। ধামনখালীর ঠিক ওপারেই মিয়ানমারের ছোট্ট গ্রাম কুমিরখালী। এই কুমিরখালী মংডু থানা এলাকায় পড়েছে। দুই দেশের এই দুটি গ্রামের মাঝে রয়েছে সরু নালা। নাফ নদের শাখা। জোয়ারের সময় হাঁটুপানি। ভাটায় থাকে কাদামাটি। দিনের বেলায় লবণচাষিদের আনাগোনা থাকে এ এলাকায়। কিন্তু রাত হলেই ভয়ংকর। রাত ১১টার পর এই সীমান্ত এলাকায় লোকজনের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায় না। রাত ২টার পর দৃশ্যপট একদম ভিন্ন। মিয়ানমারের কুমিরখালী থেকে ২৫-৩০ জনের একটি দল সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। ধামনখালী হয়ে তারা যেতে থাকে পালংখালীর দিকে। লোকজনের মধ্যে অন্তত তিনজনের মাথায় বস্তাভর্তি মাল থাকে। আর এই বস্তাগুলো সশস্ত্র পাহারা দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে তারা। প্রায় আধা কিলোমিটার পায়ে হেঁটে সশস্ত্র দলটি পালংখালীর শরণার্থী শিবির রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সামনে এসে থামে। এরপর জামতলী পয়েন্ট দিয়ে সেই তিনটি বস্তা নিয়ে ক্যাম্পের ভিতরে ঢুকে পড়ে মিয়ানমার থেকে আসা অস্ত্রধারীরা। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বিজিবি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে সশস্ত্র দলটি ঢুকে পড়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। আর এই সশস্ত্র দলটির কাছে বস্তাগুলোর মধ্যে যা থাকে, তা হলো ভয়ংকর মাদক ইয়াবা এবং আইস। মিয়ানমার থেকে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদক নিয়ে আসার এমন দৃশ্য নিত্যদিনের। কোনো ধরনের বাধাবিপত্তি ছাড়াই মিয়ানমার থেকে মাদকের চালান আসছে বাংলাদেশে। আর বাংলাদেশে ইয়াবা এবং আইসের প্রধান ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে কাজ করছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। দুই বছর আগেও ইয়াবা প্রবেশের প্রধান দরজা ছিল বাংলাদেশের শেষ প্রান্ত টেকনাফ। হালে এই মাদক কারবারের পুরো নিয়ন্ত্রণ এখন রোহিঙ্গাদের হাতে। উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পই এখন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ মাদকের আখড়া। এখান থেকেই ইয়াবা ও আইস সরবরাহ করা হচ্ছে দেশের ৬৪টি জেলায়। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ধামনখালী এলাকায় মাদক প্রবেশে বাধা দেওয়ায় মাদক কারবারিরা বিজিবিকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। বিজিবিও পাল্টা গুলি চালায়। এ সময় গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। টেকনাফ উখিয়ার সীমান্ত এলাকা ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরেজমিন অনুসন্ধানে এমন সব তথ্য উঠে এসেছে। জানা গেছে, মিয়ানমার সীমান্তের কুমিরখালী শুধু নয়, পার্শ্ববর্তী চাকমাকাটা, কোয়াঞ্চিবন, ঢেঁকিবুনিয়াসহ আশপাশের আরও বেশ কয়েকটি সীমান্তঘেঁষা গ্রাম থেকে একইভাবে ইয়াবা ও আইসের চালান ঢুকছে দেদার। প্রায় প্রতি রাতেই এই মাদকের চালান বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। মাদকের সঙ্গে ঢুকছে আগ্নেয়াস্ত্র। মাদক কারবারে জড়িত রয়েছেন এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকার জিরো পয়েন্টে থাকেন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ আল ইয়াকিনের নেতা নবী হোসেন। এই নবী হোসেনই মূলত ইয়াবা এবং আইসের কারবার নিয়ন্ত্রণ করছেন। তিনি মাদকের চালান পাঠিয়ে দেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আরেক মাফিয়া হেডমাঝি সোনালীর কাছে। ওপারে নবী হোসেন এবং এপারে সোনালী-এই দুজনে বর্তমানে বাংলাদেশে মাদক ইয়াবা আর আইস কারবারের নিয়ন্ত্রক। যদিও এদের দলে রয়েছেন অন্তত ১০ হাজার সদস্য। হেডমাঝি সোনালীর বাবার নাম সয়েদ আলম। আরও আছেন হোসেন মুরাদ, জাফর, শমসু। এরা ইয়াবা এবং আইস সারা দেশে সরবরাহ করেন। ইয়াবা এবং আইসের গডফাদার নবী হোসেনকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। তবে এখনো তাকে ধরা যায়নি। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবা-আইসের বড় চালান পাচার করাই নবী হোসেনের প্রধান কাজ। সীমান্তের কাছাকাছি পাঁচটি ক্যাম্পে তার আসা-যাওয়া রয়েছে। মিয়ানমারের বিজিপির সহায়তায় সে দেশের এক নাগরিকের মাধ্যমে দিয়েছে চিংড়ির ঘের। ক্যাম্পে তার ৩০ সহযোগীর নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের মূল কাজ মাদক পাচার ও অর্থ লেনদেন। তিন বছর আগে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) ছেড়ে ‘নসুরুল্লাহ নবী’ গ্রুপ তৈরি করে নবী হোসেন। তিনি আল ইয়াকিনের নেতা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ দমনে কাজ করা গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে নবী হোসেনের অপরাধ কর্মকাণ্ড নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন ঢাকায় পাঠিয়েছি। আমাদের তদন্তে মিয়ানমার থেকে মাদকের বড় চালান পাচারের সঙ্গে জড়িত পাঁচটি ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী’ গ্রুপের নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে অন্যতম নবী হোসেন গ্রুপ। স্থল ও নদীপথ-উভয় পথেই বেশির ভাগ মাদক চালান নবী হোসেনের হাত ধরে বাংলাদেশে আসে। মিয়ানমারে অবস্থান করলেও মাদক বাংলাদেশে নিয়ে আসে নবী। তার সহযোগীরা কেনাবেচা করে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়। এক সময় আরএসওর কমান্ডার ছিল নবী।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮ ইস্টে বসবাসকারী মোস্তাক আহমেদের ছেলে নবী হোসেন (৪৭) মিয়ানমারের মংডু ডেভুনিয়া তুমরা চাকমাপাড়ায় আরএসও কমান্ডারের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন। সেখানে প্রতিপক্ষের দ্বন্দ্বে একটি হত্যা মামলার আসামি হয়ে ২০১২ সালে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। সেখানে মাদরাসায় চাকরি নেন। ২০১৭ সালের আগস্টে তার পরিবার বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এরপর নবী হোসেন কুতুপালংয়ে পরিবারের কাছে চলে আসেন। সে সময় তাকে দলে নিতে চাপ দেয় আরসা। এতে রাজি না হলে ক্যাম্প ছাড়তে বাধ্য হয়। তখন মাদক চালানে জড়িয়ে পড়ে। এরপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাহিনী গড়ে। ২০১৮ সালে মাদকের বড় চালান নিয়ে আসে বাংলাদেশে। এরপর থেকে ইয়াবার সব বড় চালান তার হাত ধরে দেশে আসছে। এখনো আরএসওর কিছু নেতার সঙ্গে নবীর যোগাযোগ রয়েছে। ওপারে তার প্রশিক্ষণ সেন্টার আছে। সুড়ঙ্গ রয়েছে জিরো পয়েন্টে।

গত ১৫ দিনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) পৃথক অভিযান চালিয়ে প্রায় ৪৭ কেজি আইস জব্দ করেছে। এ সময় গ্রেফতার করা হয় আটজনকে। যাদের মধ্যে ছিলেন পুলিশের সাবেক এক সদস্যও। তবে অভিযানে মূল মাদক কারবারিদের ধরা যায়নি। এই আটজন ছিল আইসের বাহক। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে এবং ক্যাম্পের বাইরে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে নির্মূল করার জন্য কাজ করছে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা সংস্থাগুলো। সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। স্থানীয়দের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে সামনে চলমান অভিযান আরও বেশি জোরালো হবে বলে উল্লেখ করে স্থানীয় যারা এসব সন্ত্রাসীকে পৃষ্ঠপোষকতা করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান এসপি। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং রোহিঙ্গা প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটি মহাসচিব এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ও বাইরে অসংখ্য সশস্ত্র গ্রুপ গড়ে উঠেছে। তারা মাদকের ব্যবসা, অপহরণ, ডাকাতিসহ নানা অপরাধ করে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি এসব সশস্ত্র গ্রুপের টার্গেটে পরিণত হয়েছে স্থানীয়রা। রোহিঙ্গারা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দলবেঁধে বাড়ি ঘেরাও করে স্থানীয়দের তুলে নিয়ে মারধর করছে। অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করছে। এতে দিন দিন স্থানীয়দের নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়ছে। সামনে হয়তো ক্যাম্পের আশপাশে বসবাস করা কঠিন হয়ে যাবে। তিনি বলেন, অন্তত ৩০ হাজার রোহিঙ্গা অস্ত্রধারী রয়েছে বলে আমার মনে হয়। এসব রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের নিরস্ত্র করতে নিয়মিত সেনাবাহিনীর অভিযান অথবা ক্যাম্পের দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দিতে হবে। এ ছাড়াও মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ব্যবহার নিষিদ্ধ, ক্যাম্পের বাইরে রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাচল বন্ধ করা গেলে কিছুটা অপরাধ কমে আসবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button