অর্থ ও বাণিজ্যচট্টগ্রাম

৩৯ লাখ টাকা বকেয়া রেখে চসিকের ‘সল্টগোলা ঘাট’ চান কালো ইজারাদার

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:

প্রায় সাড়ে ৩৯ লাখ টাকা বকেয়া রেখে পুনরায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত সল্টগোলা-ডাঙারচর ঘাটটি দখলে নিতে মরিয়া কালো তালিকাভূক্ত এক ইজারাদার। চসিক সূত্রে জানা গেছে, ওই ইজারাদার দরপত্র শর্ত ভঙ্গ ও ঘাটের ব্যবস্থাপনা নীতিমালা লঙ্ঘনকারী কালো তালিকাভূক্ত হয়ে রয়েছেন। তবুও সল্টগোলা ঘাটটি পেতে তিনি অনৈতিক তদবির করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

ঘাট দখল নেয়াকে কেন্দ্র করে আশঙ্কা রয়েছে মারামারি ও সংঘর্ষসহ প্রাণহানির ঘটনার। যার পিছনে কলকাঠি নাড়ছেন স্থানীয় কিছু প্রভাবশালীরা ও জনপ্রতিনিধি।
যদিও গত ৩১ জুলাই শর্ত ভঙ্গের কারণে চসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা (উপ সচিব) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে সল্টগোলা ঘাটের ১৪৩০ বাংলা সনের ইজারা গ্রহণে দাখিলকৃত দরপত্র বাতিল ও জমাকৃত অর্থ বাজেয়াপ্ত করেছেন।

ওই চিঠিতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এর প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা জানান, চসিক নিয়ন্ত্রণাধীন সল্টগোলা ঘাটটি ১৪৩০ বাংলা সনের ইজারা গ্রহণের জন্য দাখিলকৃত দরপত্রের ৯নং শর্ত এবং ফেরিঘাটের ইজারা ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত নীতিমালার ছ (৩) অনুচ্ছেদের সরাসরি লঙ্ঘন করায় দিদারুল আলম এর ইজারা দরপত্র বাতিল এবং জমাকৃত অর্থ বাজেয়াপ্ত করার বিষয়ে চসিক অনুমোদিত করেছেন। তাঁর মানে যথা সময়ে ইজারার টাকা পরিশোধ না করায় বর্তমান ইজারাদার কর্ণফুলীর ফাজিলখাঁর হাটের দিদারুল আলম এর ইজারা বাতিল করা হয়েছে।

চসিক একই সময়ে ওই ইজারদারকে অবগত করে চিঠির অনুলিপি পাঠিয়েছিলেন মেয়রের একান্ত সচিব, চসিকের এস্টেট অফিসার ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার ব্যক্তিগত সহকারিকেও। এই আদেশ পাবার পরে গত ১৪ আগস্ট চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও এস্টেট শাখার অফিসার মো. রেজাউল করিম নতুন এক অফিস আদেশ জারি করেন।

তাঁতে উল্লেখ করেন, চসিক নিয়ন্ত্রণাধীন সল্টগোলা ঘাটটি ১৪৩০ বাংলা সনের অবশিষ্ট সময় খাস আদায়ে লোকবল সরবরাহ ও অন্যান্য সহযোগিতার জন্য কর্ণফুলী ডাঙারচর এলাকার মো. আব্বাছকে সাময়িক ভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এমনকি খাস আদায়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের খাস আদায়কারী ও এস্টেট শাখার চেইনম্যান তাঁকে সার্বিক সহযোগিতা করবেন।

এরমধ্যে ১৫ আগষ্ট হঠাৎ এস্টেট শাখার অফিসার আবার ইজারাদার মো. আব্বাছকে মুঠোফোনে জানান, ‘মেয়রের নির্দেশে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এর প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা (সিআরও) স্যার কল করে জানিয়েছেন, আপনারা আপাতত খাস আদায় করবেন না। পূর্বের ইজারাদার খাস আদায় করবেন।’

হঠাৎ এমন অনাকাঙ্খিত মৌখিক নির্দেশ মানতে নারাজ নতুন ইজারাদার। কেননা সকালে এক ধরনের লিখিত আদেশ দিলেন। বিকেলে আবার আরেক ধরনের মৌখিক আদেশ। অথচ চসিক পে-অর্ডারে টাকা গ্রহণ করে লিখিত কার্যাদেশও দিয়েছেন ইজারাদার মো. আব্বাছকে।

ওদিকে, ১৬ আগষ্ট চসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন করে পূর্বের ইজারাদার মো. দিদারুল আলমের পক্ষে মহিউদ্দিন নামে আরেক ব্যক্তি। আবেদনে তিনি জানান, ‘সল্টগোলা ঘাটের বিপরীতে ১৪৩০ বাংলা সনের ইজারা বাবদ বকেয়া ১০ লাখ টাকা জমা করেছেন। কিন্তু অবশিষ্ট ইজারা মূল্য বাবদ ১৮ লাখ ৫৫ হাজার ৮৯০ টাকা এবং সরকারি ভ্যাট-ট্যাক্স বাবদ ১০ লাখ ৯৩ হাজার ৭৬০ টাকাসহ সর্বমোট ২৯ লাখ ৪৯ হাজার ৬৫০ টাকা বাকি রয়েছে। যা আগামী বছরে পরিশোধের কথা জানান।’

যদিও তারা ইতিমধ্যে ইজারা দরপত্র শর্ত ভঙ্গ ও ঘাটের নীতিমালা লঙ্ঘন করেছেন। আবার ইজারাদার নিজেই চসিকের কাছে আবেদন না করে অন্যজনকে দিয়ে আবেদন করিয়ে ছলচাতুরী ও কৌশল নিচ্ছেন কিনা সেটাও প্রশ্ন উঠেছে। কেননা, ১০ লাখ পরিশোধ করলেও আরো বকেয়া থেকে যায় সাড়ে ২৯ লাখ টাকা।

চসিকের আদেশ মতে বর্তমান সল্টগোলা ডাঙারচর ঘাট নতুন নিয়োগ পাওয়া ইজারাদার মো. আব্বাছদের দখলে থাকায় পুর্বতন ইজারাদার কর্ণফুলীর শাহমীরপুর পুলিশ ফাঁড়িতে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগ পেয়ে দু’পক্ষকে ফাঁড়িতে বা রাতে থানায় ওসির কাছে আসার অনুরোধ জানান ফাঁড়ি আইসি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কর্ণফুলী থানার ওসি মো. দুলাল মাহমুদ বলেন, ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এস্টেট শাখা থেকে কোন একটা অফিসার কল দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। আমি বলেছি লিখিত আদেশে যারা ঘাটের খাস আদায়ের আদেশ পেয়েছেন। তারাই ঘাটে থাকবে। নতুন আদেশ আসলে ভিন্ন কথা। মৌখিক কোন আদেশ মানা সম্ভব না। আমি ওই অফিসারকে জানিয়েছি। প্রশাসন থেকে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

জানতে চাইলে সাময়িক ভাবে খাস আদায়ে দায়িত্ব পাওয়া কর্ণফুলী ডাঙারচর এলাকার মো. আব্বাছ বলেন,‘সল্টগোলা ঘাটটির ১৪৩০ বাংলা সনের অবশিষ্ট সময় খাস আদায়ের জন্য চসিক থেকে লিখিত আদেশে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমি ইতিমধ্যে ৭ লাখ টাকা খরচ করে ৩টি ইঞ্জিন চালিত নৌকা ক্রয় করেছি। এরমধ্যে চসিক যদি আবার মৌখিক নির্দেশ বা নতুন চিন্তা করে তাহলে আমি আর্থিক ভাবে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হবো। বিষয়টি লিখিতভাবেও চসিককে জানিয়েছি।’

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও এস্টেট শাখার অফিসার মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘চসিকের সিআরও স্যার ফোন করে আমাকে যা বলতে বলেছেন। আমি তা নতুন ইজারাদারকে জানিয়েছিলাম। এর বাহিরে আমি কিছু জানি না।’ ১৪ আগষ্ট লিখিত আদেশে ওদেরকে ঘাটের খাস আদায়ে কেন অনুমতি দিলেন জানতে চাইলেও তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা (উপ-সচিব) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘পুর্বতন ইজারাদার সম্ভবত মেয়র স্যারের কাছে গিয়েছিলেন। মেয়র স্যার তাদেরকে বকেয়া টাকা কিস্তি করে দেয়ার সুযোগ দিতে বললেন। এমনকি বুধবারের মধ্যে একটা বড় অ্যামাউন্ট দিতে বলেছিলেন। গতকাল তারা ১০ লক্ষ টাকার পে-অর্ডার জমা করেছেন। তাই আজকে আব্বাছের আদেশও বাতিল করা হয়েছে ।’

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন ও হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ করেও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

প্রসঙ্গত, এর আগেও চসিকের এক চেয়ারে দুই ‘সচিব’ শিরোনামে সংবাদ বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে। ফেসবুক জুড়ে ভাইরাল হয়েছে। সিদ্ধান্তহীনতায় বারবার জলাবদ্ধতার সংবাদও নেটিজনদের কাছে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। চসিকের বর্তমান সচিব খালেদ মাহমুদকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে বদলি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রণালয়। একইসঙ্গে চসিকের নতুন সচিব হিসেবে পদায়ন করা হয় সরকারী আবাসন পরিদপ্তরের (গণপূর্ত) উপ-পরিচালক কাজী শহিদুল ইসলামকে।

তবে বিপত্তি ঘটে এ কর্মকর্তা (কাজী শহিদুল ইসলাম) যখন ৭ আগস্ট চসিকে যোগদান করতে আসলেও বদলি হওয়া সচিব খালেদ মাহমুদ অবমুক্ত হননি। এরইমধ্যে ৭ আগস্ট বিকেলে চসিকের বর্তমান সচিব খালেদ মাহমুদের বদলির আদেশ বাতিল করলো মন্ত্রণালয়। এ যেন এক সিটি কর্পোরেশনেই দুই সচিব। পুরো ব্যাপারটি রীতিমতো হাস্যকর হয়ে গেছে।’

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button