বিনোদন

শাহরুখ কেন ৩০ বছর পরেও ‘বলিউডের কিং খান’

বলিউডের জনপ্রিয় তারকা শাহরুখ খান হিন্দি সিনেমায় তার অভিনয়ের ৩০ বছর পূর্ণ করলেন। ৩০ বছর পরেও তার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি, এখনও তিনি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফিল্ম আইকনদের একজন। শাহরুখ খানের দীর্ঘস্থায়ী জনপ্রিয়তা নিয়ে বই লিখেছেন শ্রায়না ভট্টাচার্য। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন কেন অগণিত ভক্তের কাছে এতো প্রিয় তিনি? কেন বহু মানুষের আরাধ্য তারকা এই শাহরুখ খান?

চলচ্চিত্র শিল্পে শাহরুখ খানের দীর্ঘ দিন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকার পেছনে কারণ হয়তো ব্যাখ্যা করা সহজ। তার লাখ লাখ ভক্ত এই তারকার গুণে এতটাই মুগ্ধ এবং তাকে তারা এতটাই ভালবাসেন, যে এটা যে একটা অন্ধ তারকা-প্রেম হতে পারে- একথা তারা মানতে একেবারেই নারাজ।

কেন তার প্রতি ভক্তদের এই প্রেম?

তার ছবিগুলোর মতই – এর উত্তর তিনি রোমান্টিক ও আবেগপ্রবণ। ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের সবচেয়ে ভালো দিকগুলোকেই তিনি সর্বদা তুলে ধরেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার যা কিছু মহৎ – চলচ্চিত্রে তিনি তার মূর্ত প্রতীক ।

শাহরুখ খান ও ভারতীয় অর্থনীতি

লাখ লাখ ভারতীয় মনে করেন, অর্থনীতিতে ভারতের অগ্রযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে আছে শাহরুখ খানের নাম। দেশটির অর্থনৈতিক উত্থানের কাহিনির তিনি ‘পোস্টারচাইল্ড’।

বিশ্ব অর্থনীতির মানচিত্রে ভারত যখন স্থান করে নিচ্ছে ঠিক সেই সময়েই চলচ্চিত্রের রুপালি পর্দায় আবির্ভাব শাহরুখ খানের। যে সময়ে ভারত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে হাঁটছে, ঠিক সেই সময়েই জনপ্রিয়তার শিখরে উঠেছেন শাহরুখ খান।

ভারতে বাজার সংস্কারের লক্ষ্যে নেয়া একের পর এক পদক্ষেপের অংশ হিসাবে টেলিযোগাযোগ খাতকে উন্মুক্ত করে দেয়া হয় বিদেশি বিনিয়োগের জন্য। এর ফলে নতুন নতুন মিডিয়া চ্যানেল ভারতে সম্প্রচারের অনুমতি পায়।

এই চ্যানেলগুলোতে সবসময় দেখানো হতো শাহরুখ খানের ছবি, তার গানের চিত্রায়ন এবং নানা সময় তার সাক্ষাৎকার। এই চ্যানেলগুলোর দৌলতেই তিনি পৌঁছে যান মানুষের ঘরে ঘরে। তার আগের যে কোন চলচ্চিত্র তারকার চেয়ে তিনি অনেক বেশি মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

ভারতের অর্থনীতি আরও উদার হতে শুরু করলে নতুন নতুন সোডা-জাতীয় পানীয় এবং গাড়ি ভারতের বাজারে ঢুকতে শুরু করে। তারা শাহরুখ খানকে তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপনে ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর’ করে নেন। কারণ এই তারকার জনপ্রিয়তা তখন আকাশচুম্বী।

সেই অর্থে বলা যায়, দিল্লির এক সাধারণ পরিবারের সন্তান থেকে তারকাখ্যাতির শীর্ষে শাহরুখ খানের উল্কার গতিতে উঠে আসার রূপকথা কাহিনির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারতের নব্য-উদারপন্থী অর্থনৈতিক সাফল্যের গল্পও।

কোন রকম বংশ পরিচয়ের সুবাদে সিনেমায় ঢোকা বা চেনাজানাদের সঙ্গে খাতির ছাড়াও যে চলচ্চিত্রে বিপুল খ্যাতি অর্জন সম্ভব, শাহরুখ খানের উত্থান তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। তার উত্থান ঘটেছে দেশটির অর্থনীতির উত্থানের হাত ধরে।

এদিকে শাহরুখ খানের ছেলে আরিয়ান খানকে গত বছর মাদক সেবনের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে প্রমাণের অভাবে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। অনেকেই বলেছিলেন ভারতের সবচেয়ে সফল মুসলিম আইকনকে টার্গেট করার জন্যই শাহরুখ খানের ছেলেকে মামলায় ফাঁসানো হয়েছিল।

খান সব সময়ই ভারতের বহুত্ববাদ নিয়ে সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন। তার সমসাময়িক অভিনেতাদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি ছবিতে মুসলিম চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

তারপরেও তার ভক্তদের কাছে কখনই তার ধর্মীয় পরিচয়টা বড় হয়ে ওঠেনি। তারা তাকে দেখেছেন জ্ঞানী, রসিক, সফল এবং ব্যাপকভাবে আবেদনময় একজন পুরুষ হিসেবে।

রোমান্টিক সুপারহিরো

সবচেয়ে বড় কথা হল, বলিউডের এই আইকন সবসময় মানব চরিত্রের নানা দুর্বলতার দিকগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন।

দুর্বল প্রেমিক, দুর্বল নায়ক, দুর্বল স্বামী, দুর্বল এক মুসলিম, এবং এমনকি দুর্বল এক খলনায়কের চরিত্রে তার অসাধারণ অভিনয় আমরা দেখেছি। এইসব চরিত্রে তিনি তুলে এনেছেন মানুষের নানা দুর্বলতার দিকগুলো। আমরা দেখেছি এই চরিত্রগুলো নিজেকে নিয়ে কতটা অস্বস্তিতে রয়েছে, এবং তাকে নিয়ে তার সহ-চরিত্রগুলোর মধ্যেও কীধরনের অস্বস্তি কাজ করছে।

রূপালি পর্দায় এই চরিত্রগুলোর মধ্যে নিরাপত্তার যে অভাবকে তিনি দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা তিন দশকে তার অভিজ্ঞতার ফসল। তার রূপায়িত এই চরিত্রগুলো প্রায়শই আবেগে ভরা নিঃসঙ্গ মানুষ- সম্পূর্ণভাবে ভালবাসা যার ভাগ্যে জোটেনি, কিন্তু ভালবাসার জন্য হাল ছাড়তে যিনি নারাজ- প্রেমের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘোরা যিনি থামাতে চান না।

শাহরুখ খান দক্ষিণ এশিয়ার রোমান্টিক সুপারহিরো – তার চলচ্চিত্রগুলোতে যে ‘দেশি’ রোমান্স উঠে এসেছে, তার সঙ্গে একাত্ম হবার, নিজের জীবনে সেই প্রেমকে অনুভব করার স্বপ্ন দেখেন দক্ষিণ এশিয়ার বহু তরুণ তরুণী।

তথ্য থেকে দেখা গেছে, বলিউডে অন্যান্য পুরুষ স্টারদের অভিনীত চরিত্রগুলোর চেয়ে শাহরুখ খান অভিনীত চরিত্রগুলো বেশি নাড়া দিয়েছে নারীদের। কিন্তু শাহরুখের অভিনীত চরিত্রগুলো শুধু প্রথামাফিক নারী প্রেমিকার ভালবাসার কাঙাল নয়, তারা বাবার ভালোবাসা, বন্ধুদের ভালবাসা এবং দেশের মানুষেরও ভালবাসা চেয়েছে।

‘গভীর অনুভূতি’র মানুষ

তার চরিত্রগুলোর মধ্যে খুবই গভীর অনুভব রয়েছে। অন্যের ব্যবহারে, অপমানে বা আঘাতে চরিত্রগুলো কান্নায় ভেঙে পড়ে – অনেক অনেক (অনেক) অশ্রু ঝরে তাদের চোখে। চলচ্চিত্রের কাহিনীকাররা প্রায়ই বলে থাকেন, বিশ্বের বেশিরভাগ অভিনেতার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় শাহরুকের মত কাঁদতে পারে খুব কম অভিনেতাই। মানুষের দুঃখ দুর্দশার অনুভূতি ফুটিয়ে তোলা তার অশ্রুসিক্ত মুখ তার অগণিত ভক্তের কাছে অনন্য করে তুলেছে।

ছায়াছবির বাইরে, টেলিভিশনে তার সাক্ষাৎকার এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার বক্তৃতা তার রসিক মন ও নম্র স্বভাবকে সামনে নিয়ে এসেছে।

আমি শাহরুখ খানের অনেক শহুরে ভক্তকে চিনি, যারা তার চলচ্চিত্রের চেয়ে তার সাক্ষাৎকারের বেশি গুণগ্রাহী।

মিডিয়াতে তার এসব সাক্ষাৎকার নিঃসন্দেহে এই সুপারস্টারের এ যাবৎ সবচেয়ে ভাল পারফরমেন্স: একজন মধ্যবিত্ত সুপারস্টারের বিনম্র ও নিঃসঙ্কোচ পরিচিতি।

তার মধ্যে ভক্তরা যেমন একজন সংযত মানুষকে দেখেন, তেমনি তার ঔদ্ধত্যকেও ভক্তরা উপভোগ করেন। কারণ নিজের বুদ্ধিমত্তা ও নিজের মতামতের কাটাছেঁড়া করতেও তিনি কুণ্ঠিত হন না।

বৈচিত্র্যময়তা

কখনও একটানা ধূমপান করছেন, কখনও আত্ম-সচেতন, কখনও ইস্পাতের মত কঠিন, কখনও আবার রঙ্গরসে ভরপুর- শাহরুখ খান কখনই একঘেঁয়ে নন।

কখনও তিনি আর্থিক সঙ্কট কীভাবে মোকাবেলা করতে হবে বা বন্ধুত্বে ফাটল ধরেছে – কীভাবে তা সামাল দিতে হবে তা নিয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন, আবার কখনও চলচ্চিত্রে শিল্পে কাজ করতে করতে বুড়ো হয়ে গেলেন বলে ঠাট্টাতামাশা করছেন, কখনও আবার নিজের যৌনতা নিয়ে কথা বলছেন – ভক্তরা তাকে পান নানা রূপে।

তবে নিজেকে নিয়ে বা বিশ্বের অন্যান্য বিষয় নিয়ে তার মন্তব্য বা ঠাট্টাতামাশা সব কিছুর মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট একটা ইঙ্গিত মেলে যে তিনি কাজের ক্ষেত্রে খাটেন, তিনি চলচ্চিত্র শিল্প নিয়ে তিনি গভীরভাবে ভাবেন এবং নিজেকে নিয়ে মজা করতে ভালবাসেন।

অনিশ্চিত ও রূঢ় বাস্তবতার বিশ্বে, শাহরুখ খানের যে অসাধারণ ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে তা তার ভক্তদের জন্য চমৎকৃত হবার এবং একইসঙ্গে বিনোদনের জন্য একটা বিরল জায়গা তৈরি করে দিয়েছে।

তিন দশক ধরে অভিনয় করে যাওয়া এই সুপারস্টারের তিনটি বড় ছবি মুক্তি পাবে ২০২৩ সালে। তার ভক্তরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন, কিন্তু মুসলিম আইকনদের এবং তাদের তৈরি ছবিকে টার্গেট করে দক্ষিণপন্থী সামাজিক মাধ্যম যেভাবে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে তাতে অনেকে শঙ্কিতও।

ভারতের রাজনীতিতে যে গভীর বিভাজন তৈরি হয়েছে, তাতে কাহিনির মধ্যে দিয়ে সমাজের সকলের মুখে হাসি ফোটানোই এখন অভিনেতাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button