অর্থ ও বাণিজ্যলাইফস্টাইল

অসময়ে শিম চাষের নৈপথ্যে আধুনিক জাত


মালিক উজ জামান, যশোর : এখন আধুনিক জাতে অসময়ে শিম চাষ হচ্ছে। ফলে দক্ষিনাঞ্চলের কৃষক অসময়ে শিমের ভাল মূল্য পাচ্ছেন। শীতের শিমের জন্য অপেক্ষার দিন শেষ হয়েছে। ফলে কৃষক ও ভোক্তার শিম সুদিন এখন ১২ মাস।
শিম প্রোটিনসমৃদ্ধ সবজি। সবুজ বিচিও পুষ্টিকর। জমি ছাড়াও রাস্তার ধারে, আইলে, ঘরের চালে, গাছে ফলানো যায়। শিম এ দেশে জনপ্রিয় শীতকালের সবজি। এখন আধুনিক জাতের কল্যাণে অসময়েও শিম চাষ করা হচ্ছে। শিম বা ফল সবজি হিসেবে রেঁধে খাওয়া হয়। সবজি হিসেবে শিম চাষ হয়। এর পাতা উত্তম পশুখাদ্য। কেউ কেউ সবুজ সার ফসল ও শোভাবর্ধক ফুল গাছ হিসেবে চাষ করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে শিমের কাঁচা বিচি আলু ও অন্যান্য সবজির সঙ্গে, শুধু বিচির তরকারি রেঁধে খায়। কেনিয়ায় প্রসূতি মায়ের বুকের দুধ বৃদ্ধিতে শিম খাওয়ায়। ফল সিদ্ধ করে ভর্তা বানিয়ে খায়। এ দেশে শিমের ভর্তা জনপ্রিয় খাবার। কোনো দেশে শিম কচি পাতা পালংশাকের মতো ভেজে খায়।
শিম ঠান্ডা ও শুষ্ক জলবায়ুতে ভালো হয়। এটি হ্রস্ব দিবসী উদ্ভিদ। গাছের দৈহিক বৃদ্ধিতে উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু ও দীর্ঘ দিন দরকার হয়। অতীতে এ দেশের জাতে কোনোভাবে মধ্য অক্টোবরের আগে ফুল আসত না। এখন গ্রীষ্মকালীন জাত উদ্ভাবিত হওয়ায় জুন-জুলাইয়ে ফল ধরছে। এসব জাতের গাছ তাপমাত্রা ও দিবস নিরপেক্ষ হওয়ায় বছরের যে কোনো সময় লাগালে শিম হচ্ছে। দোঁ-আশ ও বেলে দোঁ-আশ মাটিতে তা ভালো হয়। নদী তীরের উর্বর পলিমাটিতেও ভালো হয়। দেশে ৫০ এর বেশি স্থানীয় শিম জাত আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য; বাইনতারা, হাতিকান, চ্যাপ্টা শিম, ধলা শিম, পুঁটি শিম, ঘৃত কাঞ্চন, সীতাকুন্ডু, নলডক ইত্যাদি। বারি শিম ১, বারিশিম ২, বারি শিম ৫, বারি শিম ৬, বিইউ শিম ৩, ইপসা শিম ১, ইপসা শিম ২, একস্ট্রা আর্লি, আইরেট ইত্যাদি আধুনিক উচ্চফলনশীল জাত। বারি শিম-১ মাঝারি আগাম জাত। আষাঢ় থেকে ভাদ্র মাসে বীজ বপন করতে হয়। প্রতি শিমের ওজন ১০-১১ গ্রাম, শিমে ৪-৫ টি বীজ হয়, গাছপ্রতি ৪৫০-৫০০টি শিম ধরে। জীবনকাল ২০০-২২০ দিন। হেক্টর প্রতি ফলন ২০-২২ টন। বারি শিম-২ আগাম জাত। আষাঢ় থেকে ভাদ্র মাসে বীজ বপন করতে হয়। প্রতি শিমের ওজন ১০-১৩ গ্রাম, শিমে ৪-৫টি বীজ হয়, গাছপ্রতি ৩৮০-৪০০টি শিম ধরে। জীবনকাল ১৯০-২১০ দিন। হেক্টরপ্রতি ফলন ১০-১২ টন। বারি শিম-৫ শীতকালে হয়। গাছ খাটো, লতায় না বলে এ গাছে মাচার দরকার হয় না। বীজ বোনার ৩৫ থেকে ৪৫ দিন পর শিম তোলা শুরু হয়। প্রতি গাছে ৫০ থেকে ৭০টি ফল ধরে। জীবনকাল ৭৫ থেকে ৮০ দিন, হেক্টরপ্রতি ফলন ১২.১৩ টন। বারি শিম-৬ ফল কম আঁশযুক্ত, লম্বাটে, দেখতে অনেকটা নলডক শিমের মতো। গাছপ্রতি ৩০০ থেকে ৩৫০টি শিম ধরে। রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়। ফলন হেক্টর প্রতি ১৭ থেকে ২০ টন। জীবনকাল ২২০ থেকে ২২৫ দিন।
বিইউ শিম-৩ সারা বছর চাষ হয়। গ্রীষ্ম মৌসুমে চাষ উপযোগী। শিমের রঙ বেগুনি। প্রতি শিমে গড়ে ৫ বীজ হয়। হেক্টরপ্রতি ফলন ৭-৮ টন। ইপসা শিম-১ সারা বছর চাষ হয়। শিমের রঙ বেগুনি। প্রতি শিমে গড়ে ৫ বীজ হয়। হেক্টরপ্রতি ফলন ৫-১০ টন। ইপসা শিম-২ সারা বছর চাষ হয়। গ্রীষ্ম মৌসুমে চাষ উপযোগী। রঙ সাদাটে সবুজ। প্রতি শিমে গড়ে ৪ বীজ হয়। হেক্টর প্রতি ফলন ৭-৮ টন। বর্ষাকালে বাড়িতে নিরাপদ স্থানে পলিব্যাগে চারা তৈরি করতে হবে। শ্রাবণ শেষে বা ভাদ্র মাসে ১০- ১৫ দিন বয়সী সেসব চারা মাদায় রোপণ করতে হবে। বেশি জমিতে আবাদ করা হলে সে জমিতে কয়েক চাষ-মই দেয়া ভালো। চাষের পর ২.৫ মি: চওড়া বেড তৈরি করতে হবে। প্রতি বেডের মধ্যে ৫০ সে:মি: চওড়া ও ১৫ সে:মি: গভীর নালা রাখতে হবে। প্রতি বেডের কিনার থেকে ৫০ সে:মি: বাদে সারি করে মাদার জায়গা ঠিক করতে হবে। বেডের উভয় পাশে ৫০ সে:মি: বাদ দিলে বেডে ২ সারির মধ্যে দূরত্ব থাকবে ১.৫ মি:। জোড়া সারি পদ্ধতিতে প্রতি সারিতে ১.৫ মিটার পর পর মাদা তৈরি করতে হবে। মাদার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতার আকার ৪০ সে:মি: রাখতে হবে। এখন অনেকে বেড ২.৫ মিটার চওড়া না করে ১ মি: চওড়া করে বেড তৈরি করছেন ও সে বেডের মাঝখানে এক সারিতে ১ থেকে ১.৫ মি: পর পর মাদা তৈরি করে বীজ বুনছেন। এতে পরিচর্যা ও ফল তুলতে সুবিধে। ঈশ্বরদী, পাবনা ও যশোরে মাঝারি নিচু জমিতেও শিম চাষ হয়। সে ক্ষেত্রে মাদা তৈরির আগে মাদার চিহ্নিত স্থানে মাটি তুলে ঢিবির মতো উঁচু করে কয়েকদিন রেখে দিয়ে তারপর সেই ঢিবিতে মাদা তৈরি করে বীজ বুনছেন।
খুলনা ও যশোরের নিচু জমিতেও শিম চাষ হয়। সে ক্ষেত্রে সরজান/কান্দিবেড় পদ্ধতিতে ০.৫ থেকে ১ মি: গভীর ও ১ মি: চওড়া করে নালা/পরিখা খুঁড়ে সে মাটি দুপাশে উঁচু বেডের মতো তুলা হয়। এসব বেডে মাদা করে শিম চাষ হচ্ছে। নালার ওপরে থাকছে মাচা, নিচে পানিতে দ্রুত বর্ধনশীল মাছ চাষ হচ্ছে। আষাঢ়-ভাদ্র পর্যন্ত বীজ বোনার উপযুক্ত সময়। প্রতি মাদায় ৩/৪ বীজ বুনতে হবে। মাদায় সার মেশানোর ৪/৫ দিন পর বীজ বুনতে হবে। বীজ বপনের আগে ১০-১২ ঘণ্টা বীজ ভিজিয়ে নিতে হবে। গজানোর পর ৮/১০ দিনে প্রতি মাদায় ১টি করে সুস্থ চারা রেখে বাকি চারা তুলে ফেলতে হবে। হেক্টরে ৭.৫ কেজি বীজ লাগে (শতকে ৩০ গ্রাম)। জুন মাসে/আষাঢ় মাসের মাঝ সময় থেকে বীজ বপন করে। আগাম শিমে এ সময় উত্তম। গ্রীষ্মকালীন জাতে বছরের যে কোনো সময় বীজ বোনা যায়। এক মাদা থেকে অন্য মাদার দূরত্ব ১-১.৫ মিটার হলে ভালো। গাছের গোড়ায় পানি না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে জমিতে প্রয়োজন মতো সেচ দিতে হবে। মাঝে মধ্যে মাটি নিড়ানি দিয়ে মাদার মাটি আলগা করে দিতে হবে। গাছ যখন ১৫-২০ সে:মি: লম্বা হবে তখন মাদার গাছের গোড়ার পাশে বাঁশের ডগা মাটিতে পুঁতে বাউনির ব্যবস্থা করতে হবে। পুরনো মরা শাখা, ডগা ছাঁটাই করে পরিষ্কার করতে হয়। ফুল না ফোটা ডগা ছেঁটে পরিষ্কার করলে গাছে বেশি ফুল আসে। ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ কমাতে, বেশি ফুল ধরাতে জড়াজড়ি করে থাকা ডগার প্যাঁচ খুলে দিতে হবে। জাতভেদে বীজ বোনার ৯৫-১৪৫ দিন পর শিম তোলা যায়। আশ্বিন-কার্তিক মাসে ফুল ধরে। ফুল ফোটার ২০-২৫ দিন পর ফসল সংগ্রহ করা যায়। শিমগাছ ৪ মাসের বেশি ফল দেয়। ফলন প্রতি শতকে ৬০ থেকে ৮০ কেজি, হেক্টরপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button