শীর্ষ নিউজ

মণিরামপুরে ২০০ পরিবারের ভাগ্য বদল


মালিক উজ জামান, যশোর : যশোরের মণিরামপুর উপজেলার পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠী। পাঁচ প্রজন্মের দীর্ঘ সাধনায় দুই গ্রামের ২০০ পরিবার এখন স্বাবলম্বী। পাশাপাশি পাল্টে দিয়েছে এলাকার চিত্র। বাপ-দাদার পেশায় ভর করে আধুনিক উৎকর্ষতা দিয়েছে তৈরি পণ্যে। তাদের কাজের স্বীকৃতিও মিলেছে। ‘জীবিকায়ন শিল্প পল্লী’ ঘোষণা দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে সরকার। কুড়িয়ে পাওয়া টায়ার টিউব দিয়ে বৃটিশ আমলে যশোরের মণিরামপুর বাজারের কালিবাড়ির সামনে পাতা দাস বা পাতা বুড়ো জুতা বানানোর যে পেশা শুরু করেছিলেন তার পরবর্তী প্রজন্ম আর ছাড়েননি। সেই কুড়িয়ে পাওয়া ফেলনা জিনিসপত্র দিয়েই তার বংশধররা এখন তৈরি করছেন শতাধিক পণ্য। মণিরামপুরের খানপুর ইউনিয়নের বালিয়াডাঙ্গা ও মাছনা গ্রাম এখন স্বীকৃত ‘শিল্পপল্লী’। স্থানীয়দের কাছে যা ‘ঋষিপল্লী’ বা ‘মুচিপাড়া’ নামে পরিচিত।
গ্রাম দুটির বাড়ি বাড়ি পণ্য তৈরির কাজে ব্যস্ত কারখানা মালিক ও শ্রমিকেরা। কারখানা বলতে সাধারণত যেটা বোঝানো হয় এই পল্লীতে তা নেই। প্রায় প্রতিটি বাড়ির উঠোন, বারান্দা বা ঘরে তৈরি হচ্ছে পণ্য। এগুলোর জন্য টায়ার-টিউবসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি এনে ঢিবি করে রাখা হয়েছে। এগুলো তাদের কাঁচামাল। উৎপাদিত পণ্যগুলো গুছিয়ে রাখা হয়েছে পাশেই। এসব কারখানায় স্থানীয় মানুষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করে ভালো রোজগারও করছেন। শ্রমিকরা জানালেন, ২০০ বাড়িতে কারখানা গড়ে উঠলেও বড় পরিসরে কাজ হয় ১৩টিতে। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ৬০ জন শ্রমিক। প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কাজের সময়। কাজের চাপ থাকলে ওভারটাইম খাটতে হয়। তারজন্য আছে বাড়তি মজুরি। শ্রমিকদের কাজ উপকরণগুলো কেটে, গুছিয়ে পণ্য তৈরির জন্য প্রস্তত করা। নির্ধারিত সময়ের জন্য পুরুষদের মজুরি দিনে ৫০০-৬০০ টাকা। নারীরা সংসারের স্বাভাবিক কাজ করার অবসরে এসে সময় দেন। সে কারণে তাদের মজুরি কম-দিনে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। এই দুই পল্লীর ঘরে ঘরে তৈরি বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা শুধু বাংলাদেশে নয় পার্শ্ববর্তীদেশ ভারতেও রয়েছে। সাইকেল থেকে শুরু করে, বাস-ট্রাকের যন্ত্রাংশ পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে ফেলে দেয়া ককশিট, হ্যালাইড, মোটা কাগজ, টিন, পিতল থেকে। পাতা বুড়োর দা-বটির জায়গায় এখন পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রেসার মেশিন, হাইস্পিড ব্লেড এবং মোটরসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি। দুই গ্রামের প্রায় দুইশ’ পরিবারের কারখানায় তৈরি হচ্ছে নানা পণ্য। এলাকা ঘুরে পল্লীবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, পূর্বসুরিদের দেখানো পথে আস্তে আস্তে টায়ার-টিউবের কাজ আয়ত্ব করেছেন তারা। দিনে দিনে তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটে। তাদের পল্লীতে সার্বিক উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতে শুরু করে ৯০’র দশক থেকে।
বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা নিশিকান্ত দাস জানান, আজকের এই অবস্থানে আসতে বিশেষ করে দুই প্রজন্মের অবদানের কথা স্মরণ করলেন। ৮০’র দশকে চতুর্থ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে তিনিসহ পরিতোষ, শিবনাথ, স্বপন দাস, প্রভাষ, মহানন্দ দাস, বংশি দাসরা অত্যাধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করেছেন। ৯০’র দশকের প্রতিনিধিরা যেটাকে আরও এগিয়ে নেন। মাছনার হৃদয় দাসের স্ত্রী সুস্মিতা রাণী, নীলপদ দাস, উষা কর দাস জানান, মূলত ৯০’র দশকে তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ শুরু হয়। তারা ট্রাক ভরে পণ্য নিয়ে যেতেন বগুড়া, রংপুর, নওগাঁসহ উত্তরবঙ্গের নানা জেলায়। তখন লালনশাহ সেতু হয়নি। পাকশি ব্রিজের নীচ দিয়ে ফেরিতে বাস-ট্রাক পারাপার হতো। ঘাটে কুলিসহ দালালরা বস্তাপ্রতি ৪০০/৫০০ টাকা চাঁদা নিতো। দিতে না পারলে নানা অত্যাচার চালাতো। ট্রাক থেকে বস্তা ফেলে দিত ঘাটে বা নদীতে। সেতু হওয়ার পর সেই অত্যাচার কমেছে। বাজার হয়েছে সম্প্রসারিত। আগে যেখানে দশ দিনে পণ্য পৌঁছাতো না গন্তব্যে, এখন তা পৌঁছে যায় ২৪ ঘণ্টায়। শুধু উত্তরবঙ্গ না, রাজধানীসহ দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় এখন পৌঁছে যাচ্ছে যশোরের মণিরামপুরের এই উৎপাদিত পণ্য। পণ্য তৈরির কাঁচামাল যেমন পুরাতন টায়ার-টিউব, গার্মেন্টসের পাইপ ইত্যাদি দেশের প্রায় সব জেলায় পাওয়া যায়। তবে বেশি পাওয়া যায় যশোর, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বগুড়া জেলায়। এগুলো তারা স্বল্পমূল্যে কিনে নিয়ে আসেন। স্থানীয়রা জানান, তাদের পণ্যের ক্রেতা প্রধানত সাইকেল, মোটরসাকেল, মোটরপার্টস, স্যালো পার্টস, সেনিটারির এবং হার্ডওয়ারের দোকানদাররা। এখান থেকে পণ্য কিনে নিজেরা পাইকারি বা খুচরা বিক্রি করেন তারা। এখন আর পণ্য নিয়ে ছুটতে হয় না এই উৎপাদনকারীকে। মোবাইলে চাহিদা এবং টাকা পরিশোধ করলে কুরিয়ারে পণ্য চালান দিয়ে দেন। টাকা লেনদেন হয় ব্যাংকিং চ্যানেলে।
কুড়েঘর থেকে এখন পাকা বাড়িতে উঠেছেন পিছিয়ে পড়া এ জনগোষ্ঠী। এলাকার শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ বাড়ি পাকা। স্বাস্থ্য সম্মত টয়লেটের পাশাপাশি বাড়ি বাড়ি বসেছে আর্সেনিকমুক্ত টিউবওয়েল। ঘরে ঘরে রঙিন টেলিভিশন। জরাজীর্ণ পুরাতন মন্দির সংস্কার হয়েছে। অনেকের বাড়িতে রয়েছে গোয়ালঘর। বাড়ি-ঘর-দূয়ার সবই গোছালো, পরিপাটি। সন্তানরা লেখাপড়া শিখছেন। শিক্ষা জীবন শেষ করে অনেকে চাকরি করছেন সচিবালয়, পুলিশ, বিজিবি, মোংলা পোর্ট, বেসরকারি সংস্থা ও কোম্পানিতে। মূলত পাঁচ প্রজন্মের লাগাতার পরিশ্রম ও সংগ্রামের পর একদার ‘অচ্ছুৎ’ পরিচয় পেরিয়ে তারা আজ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে শির উঁচু এক মানব গোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীর কর্মবিপ্লব নজরে এনে সম্প্রতি এগিয়ে এসেছেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য এমপি। এতেই ভাগ্য বদলালেন তারা। গড়ে উঠলো শিল্পপল্লী উদ্যোগে এ পেশায় কর্মজীবীদের দক্ষতা বৃদ্ধি, পণ্যের গুণগত মান উন্নয়ন ও আর্থিক সংকট দূর করতে নানা প্রকল্প নিয়েছে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি)। সেই সূত্র ধরেই সম্প্রতি পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য এমপি বালিয়াডাঙ্গা এবং মাছনার ঋষিপল্লীকে ‘জীবিকায়ন শিল্প পল্লী’র উদ্বোধন করেছেন। শিল্প পল্লীর বাসিন্দারা জানান, তাদের উৎপাদিত ক্ষুদ্রপণ্যের কদর পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কোলতাকায়ও আছে। এখান থেকে কেউ কেউ সেখানে যেয়ে কারখানাও তৈরি করেছেন। কিন্তু, তাদের পণ্যের ফিনিশিং খুব একটা ভালো না। সে কারণে অনেকে এখান থেকে পণ্য কিনে চোরাইপথে ভারতে নিয়ে যাচ্ছেন। এতে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। স্থানীয়দের সুপারিশ সরকার যদি তাদের পণ্য রপ্তানিতে সহায়তা করে তাতে নিজেরা যেমন লাভবান হবেন, তেমনি সরকারও রাজস্ব লাভ করতে পারবে। পণ্য উৎপাদনে মূলধনের জন্য এক সময় এনজিও থেকে উচ্চসুদে ঋণ নিতেন। এখন ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ায় কমেছে এনজিও ঋণ বোঝা। নির্ধারিত ঋণ সুবিধার বদলে চাহিদা অনুযায়ী ঋণ প্রদানের আশা করেন তারা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button