কালনা সেতু চালুর অপেক্ষায় ফুল ও সব্জী চাষীরা
যশোরের ফুল-সবজি সর্বোচ্চ ৪ ঘণ্টায় ঢাকায় পৌঁছাবে
মালিক উজ জামান, যশোর : পদ্মার পর কালনা সেতু চালু হলে ফুলের রাজধানী যশোরের গদখালীর ফুল অতিদ্রুত পৌঁছাবে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে। ফেরিঘাট জটে পড়ে নষ্ট হবে না ফুল। তরতাজা থাকায় দাম ভালো পাওয়া যাবে। এতে চাষিরা উপকৃত হবে। তাই অপেক্ষায় ফুল ও তরিতরকারি তথা সব্জী চাষীরা। গদখালীর স্থানীয় ফুলচাষীরা তাদের এসব আশার কথা বলেছেন।
দেশের চাহিদার ৬০-৭০ শতাংশ ফুল যশোর থেকে সরবরাহ হয়। এই অঞ্চলের প্রায় ১৫০০ হেক্টর জমিতে আট হাজারের মতো চাষি ফুল চাষ করেন। প্রায় সারাবছর এখান থেকে কমবেশি ফুল পাঠানো হয়। বিশেষ দিন ও উৎসবকে ঘিরে ফুল বেচাকেনার রেকর্ড হয়। কালনা সেতু চালু হলে চার ঘণ্টায় ফুল পৌঁছে যাবে ঢাকায়। এতে ফেরিঘাটে আটকে থেকে ফুল নষ্ট হওয়ার আর কোনও ভয় থাকবে না। আবার ফেরিঘাটের অজুহাতে পাইকারদের কম দাম দেওয়ার দিন ফুরাবে। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম জানান, কালনা সেতু চালু হলে ঘাটের বিড়ম্বনা মোটেও থাকবে না। এতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে দ্রুত সময়ে ফুল পাঠাতে পারবো। সাধারণত এখন সবজির ট্রাকে ও যাত্রীবাহী বাসে বান্ডিল করে ফুল পাঠাই। সেক্ষেত্রে বান্ডিল প্রতি এখন খরচ ৩০০ টাকা। সেতু চালু হলে খরচ এদিক ওদিক হতে পারে। সেক্ষেত্রে ফুলের দাম ‘কস্ট অ্যনালাইসিসের’ মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে। তবে শেষ পর্যন্ত চাষিরা লাভবান হবে। পদ্মা সেতু চালু হলে যশোর থেকে উৎপাদিত শাক-সবজি দ্রুততম সময়ে রাজধানীতে চলে আসবে। ঘাটে আটকে থেকে নষ্ট হওয়ার ভয় নেই। এতে চাষিরা ভালো দাম পাবেন। যশোরের পাইকাররা জানান, কালনা সেতু চালু হলে সর্বোচ্চ চার ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা যাত্রাবাড়িতে সবজি পৌঁছে দিতে পারবো। এতে যেমন সময় বাঁচবে, তেমনি সবজি বিনষ্ট হওয়ার শঙ্কা থাকবে না। সহজে ও স্বল্পমূল্যে সবজি পৌঁছানো যাবে ঢাকায়। ক্রেতারা কমদামে সবজি কিনতে পারবেন। স্থানীয় চাষিরা জানান, যশোরে রবি, খরিপ-১ ও খরিপ-২ এই তিন মৌসুমে যথাক্রমে ১৬ হাজার, ১৪ থেকে ১৫ হাজার এবং ৬ থেকে ৮ হাজার হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়। এ ধারাবাহিকতায় প্রায় সাড়ে ৮ লাখ মেট্রিকটন সবজি উৎপাদন হয়। যশোরের চাহিদা প্রায় সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিকটন। উদ্বৃত্ত অংশ ঢাকাসহ অন্যান্য জেলায় সরবরাহ করা সম্ভব হবে। কালনা সেতু চালু হলে ঢাকায় দিনের কাজ দিনে শেষ করে বাড়ি ফেরা যাবে মনে করেন যশোরের কয়েকজন চাকুরিজীবি। এরা জানান, সেতু উদ্বোধন হলে ভোরে রওনা হয়ে সকালে ঢাকা পৌঁছুতে পারবো। দিনের কাজ শেষে আবার ফিরে আসা তখন সম্ভব। এই সেতুর ফলে আমাদের ঢাকার দূরত্ব কমবে। ঘাটের ঝামেলা পোহাতে হবে না। যশোরের অধিকাংশ মানুষের একই ধারনা রয়েছে। দীর্ঘসময় ধরে ফেরির জন্যে অপেক্ষার দিন শেষ হচ্ছে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। যশোর থেকে ঢাকা যেতে সড়কপথে সময় লাগে ৫/৬ ঘণ্টা। কালনা সেতু চালু হলে এমন অবস্থা শেষ হবে। সময়মতো পৌঁছে যাবে মাছ, সবজি, ফুলসহ বিভিন্ন কাঁচামাল। সেই অপেক্ষায় সকল।
রেণু উৎপাদনের জন্য যশোরের চাঁচড়া এলাকা সু প্রসিদ্ধ। প্রতি সপ্তাহে ১০ প্রজাতির চার থেকে পাঁচ হাজার কেজি রেণু এখানে উৎপাদন হয়। স্থানীয় মৎস্যচাষিদের দবি, দেশে রেণুর মোট চাহিদার অর্ধেকর বেশি সরবরাহ করা হয় এখান থেকে। এখানকার চাষিরা আশা করছেন, কালনা সেতু চালু হলে প্রতিদিন প্রায় ৩০ লাখ টাকার রেণু বিক্রি করা যাবে। এতে করে ব্যবসার পরিধি বাড়বে, লাভবান হবেন মৎস্যচাষি, ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। যশোর জেলা মৎস্য হ্যাচারি মালিক সমিতির সভাপতি ফিরোজ খান জানান, এই অঞ্চলে প্রায় ১০ হাজার মৎস্যচাষি রয়েছেন। কালনা সেতু চালু হলে ফেরিঘাটে ভোগান্তি, পোনা বিনষ্ট, পথে পথে চাঁদাবাজির হাত থেকে রক্ষা পাবো। সেতু চালু হলে ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম ও বরিশালে ব্যবসা সহজ হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবহন সংস্থা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আজিজুল আলম মিন্টু জানান, পদ্মা সেতুর ফলে মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে। রাস্তার দূরত্ব ও সময় কমবে, ভালো রাস্তা হলে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও কমবে। দ্রুত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে বলে ট্রিপও বেশি হবে। এতে আয় বাড়বে। বাস সেতু দিয়ে যাবে না ফেরিঘাট পার হবে- এটি শ্রমিকদের কোনও বিষয় নয়। মালিকরা যেভাবে চালাতে বলবেন; আমরা সেভাবে চালাবো। যশোর জেলা ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, ট্যাংকলরি (দাহ্য বাদে) শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) লুৎফর রহমান জানান, কালনা সেতু হয়ে যারা মাল পরিবহন করবেন, তাদের ইচ্ছাটাকে প্রাধান্য দেবো। যশোর বাস মালিক সমিতির সভাপতি বদরুজ্জামান বাবলু জানান, কালনা সেতু চালু হলে যশোরের যাত্রীদের সময় ও দূরত্ব কমবে। যশোর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান জানান, পদ্মার পর কালনা সেতু আমাদের অঞ্চলের অর্থনীতির নতুন দরজা খুলে দেবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ ও দ্রুত হওয়ায় এখানে ইপিজেড বা অর্থেনৈতিক অঞ্চল গড়ার যে ঘোষণা, তা দ্রুত বাস্তবায়ন হবে। নতুন নতুন কলকারখানা গড়ে উঠবে। শিল্পের প্রসার ঘটবে। ফলে আমাদের এই অঞ্চলে একটি ব্যাপক অংশের মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।