হামলা-সংঘর্ষ জেলায় জেলায়
বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ চলাকালে গতকাল পুলিশ, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ত্রিমুখী সংঘর্ষে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এতে ৫০ শিক্ষার্থী ও পুলিশসহ দুই দলের শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে টিয়ার শেল ও গুলি ছুড়েছে পুলিশ। এ ছাড়া ঝিনাইদহে বিএনপির ১২০ জন আহত হয়েছেন। তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর অদূরে সাভারে পুলিশ-যুবদলের সংঘর্ষে ২৫ জন আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় যুবদলের ৩০ নেতা-কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। পিরোজপুরে আওয়ামী লীগের হামলায় বিএনপির ২৫ জন নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। নেত্রকোনার মদনে সংঘর্ষে তিন পুলিশসহ আহত হয়েছেন ১৭ জন। আর বগুড়ায় আহত হয়েছেন তিনজন। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জে বিএনপির সমাবেশে লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ। নরসিংদীর মনোহরদীতে সাবেক এমপিসহ বিএনপির ২২৩ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দায়ের করেছে।
আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর- কুমিল্লা : জেলার নাঙ্গলকোটে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও পুলিশের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল সকাল ৯টার দিকে নাঙ্গলকোট পৌর এলাকায় সংঘর্ষ শুরু হয়ে দুপুর ১২টা পর্যন্ত টানা তিন ঘণ্টার এ সংঘর্ষে ৫০ জন শিক্ষার্থী ও পুলিশসহ দুই দলের শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় নাঙ্গলকোট বাজার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ার শেল ও গুলি ছোড়ে। অন্যদিকে সদর দক্ষিণ উপজেলার সুয়াগাজী বাজারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একই স্থানে পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। নাঙ্গলকোটে সংঘর্ষ চলাকালে উপজেলা বিএনপির কার্যালয়, লোটাস চত্বর, এ্যাপোলো হাসপাতাল, বেশ কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া পুলিশের পিকআপ ও কয়েকটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়। আহতদের নাঙ্গলকোট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কুমিল্লার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সংঘর্ষের সময় বিএনপি ও ছাত্রদলের সাতজন নেতা-কর্মীকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। জানা গেছে, নাঙ্গলকোট উপজেলা বিএনপির ডাকা বিক্ষোভ সমাবেশে সকাল ৯টার আগ থেকেই খ- খ- মিছিল নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। লোটাস চত্বরসহ বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিলে পুলিশি বাধার মুখে পড়েন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। পুলিশি বাধার মুখে পড়া অবস্থায় তারা লোটাস চত্বরে নৌকা প্রতীক ভাঙচুর করে। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে যান বিএনপির নেতা-কর্মীরা। এ সময় ওসিসহ পুলিশের চারজন সদস্য আহত হন। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বিএনপির নেতা-কর্মীদের প্রতিহত করতে আসেন। উভয় দলের নেতা-কর্মীরা পাল্টাপাল্টি ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। দীর্ঘ তিন ঘণ্টা ধরে চলতে থাকা সংঘর্ষে পথচারী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষ ও ভাঙচুরের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। উপজেলা বিএনপির সভাপতি নজির আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করছিলাম। পুলিশ আমাদের ওপর অন্যায়ভাবে লাঠিচার্জ করেছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। এতে আমাদের ১৫ জন কর্মী আহত হয়েছেন।’ উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক অধ্যক্ষ সাদেক হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ অবস্থান নিই। বিএনপির নেতা-কর্মীরা উপস্থিত হয়ে বিক্ষোভের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। পুলিশ তাদের বাধা দেয়। আমরা কারও ওপর হামলা করিনি।’ নাঙ্গলকোট উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. দেবদাস দেব বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৫ জন স্কুলশিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে ২২ জন প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে গেছে। নাঙ্গলকোট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফারুক হোসেন বলেন, ‘আমাদের বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।’ সংঘর্ষে আহতদের মধ্যে ছাত্রদল নেতা সাইদ ইকবাল, বাবলু, নজির আহম্মেদ সুমন, ফারুক হোসেনসহ বিএনপির অর্ধশত এবং আওয়ামী লীগের চারজন নেতা-কর্মী রয়েছেন বলে জানা গেছে। বগুড়া : বগুড়ার নন্দীগ্রামে আওয়ামী লীগ-বিএনপির সংঘর্ষে তিনজন আহত হয়েছেন। এ সময় তিন-চারটি মোটরসাইকেল ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় প্রশাসন। গতকাল দুপুর থেকেই নন্দীগ্রাম মাজগ্রাম এলাকায় উভয় পক্ষ পাল্টাপাল্টি সমাবেশ আহ্বানের কারণে উত্তেজনা শুরু হয়। পরে দুপুরে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। সংঘর্ষে উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইয়াছিন আলী ও বুড়ইল ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন মন্টু আহত হন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কলেজ মাঠ ও বঙ্গবন্ধু চত্বরে অবস্থান নেন। নন্দীগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, দুই দলের কর্মসূচির কারণে সকাল থেকেই পুলিশ সতর্ক অবস্থানে ছিল। পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
পিরোজপুর : পিরোজপুরের নেছারাবাদে আওয়ামী লীগের হামলায় বিএনপির ২৫ নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। দুপুরে উপজেলার নেছারাবাদে হামলার এ ঘটনা ঘটে। জানা গেছে, বিএনপির বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নিতে ট্রলারযোগে যাওয়ার সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা ট্রলারে ইটপাটকেল ছোড়েন। এতে জেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মারুফ হাসান, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম, পৌর স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব আশরাফুল আলম সজলসহ স্থানীয় ২৫ নেতা-কর্মী আহত হন। নেছারাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবির হোসেন জানান, বিএনপির নেতা-কর্মীরা তাদের সমাবেশ করেছে। হামলার কোনো ঘটনার বিষয় তার জানা নেই। রাঙামাটি : রাঙামাটির দুর্গম এলাকা জুরাছড়ি উপজেলায় ১৪৪ ধারা জারি করে উপজেলা প্রশাসন। সকাল থেকেই ১৪৪ ধারা জারি বাস্তবায়ন করতে মাঠে স্থানীয় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করে। জুরাছড়ি উপজেলা বিএনপি গতকাল সকালে উপজেলার যক্ষ্মাবাজারে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেয়। অন্যদিকে একই দিন একই স্থানে উপজেলা যুবলীগ ও ছাত্রলীগও বিক্ষোভ সমাবেশের ঘোষণা দেয়। এতে শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কায় সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। নেত্রকোনা : নেত্রকোনার মদন উপজেলার চানগাঁও ইউনিয়নে বিএনপি-আওয়ামী লীগের সংঘর্ষে তিন পুলিশ সদস্যসহ ১৭ জন আহত হয়েছেন। বিএনপি বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করলে এ সংঘর্ষ ঘটে। সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে মদন থানার ওসি ফেরদৌস আলমসহ তিন পুলিশ সদস্য আহত হন। উপজেলার চানগাঁও ইউনিয়নের শাহপুর গ্রামের ঈদগাহ মাঠে সংঘর্ষের ঘটনায় এলাকাজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
ঝিনাইদহ : বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপর দেশি অস্ত্র, লাঠি, রামদা, হকিস্টিক ও হাতুড়ি দিয়ে হামলা করা হয়েছে। ভাঙচুর ও লুট করা হয়েছে বিএনপি নেতাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়ি ঘর। হামলায় বিএনপির ১২০ জন নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২৭ জন গুরুতর আহত হয়ে ঝিনাইদহ, কালীগঞ্জ, শৈলকুপা, ঢাকা ও যশোরের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। মঙ্গলবার বিএনপির সমাবেশে আসার পথে আওয়ামী লীগ এ হামলা চালায়। গতকাল দুপুরে এইচএসএস সড়কে ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেন জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট এম এ মজিদ।
নারায়ণগঞ্জ : মহানগর বিএনপি ও যুবদলের বিক্ষোভ সমাবেশে পুলিশের লাঠিচার্জের ঘটনা ঘটেছে। এতে বিএনপি ও যুবদলের ১০ জন নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। শহরের মন্ডলপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় লোকজন জানান, বিকালে বিএনপির নেতা-কর্মীরা কর্মসূচি পালনের জন্য শহরের মন্ডলপাড়া এলাকায় জড়ো হতে শুরু করলে পুলিশ এসে তাদের কর্মসূচি পালন করতে নিষেধ করে। কিছুক্ষণ পর যুবদলের নেতা-কর্মীরা মিছিল নিয়ে এলে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। সেই সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র নেতাদেরও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপু বলেন, ‘আমরা কর্মসূচি পালন করতে না পেরে রাস্তায় অবস্থান করছিলাম। এ সময় সদর থানার ওসি আনিছুর রহমানের নেতৃত্বে আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর অতর্কিতভাবে হামলা চালানো হয়। পুলিশের লাঠিচার্জে আমাদের অনেক নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন।’ এ বিষয়ে সদর মডেল থানার ওসি আনিচুর রহমান মোল্লা বলেন, নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে কর্মসূচি পালন করতে চেয়েছিল তারা। পরে পুলিশের সদস্যরা তাদের সরিয়ে দেন। সাভার : সাভারে পুলিশের সঙ্গে যুবদল নেতা-কর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে তিনটি ককটেল ও দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। খবর পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে অভিযান চালিয়ে বিএনপি ও যুবদলের ৩০ নেতা-কর্মীকে আটক করেছে। এ ছাড়া পুলিশ যুবদল নেতা খোরশেদ আলমের বাড়ি ঘেরাও করে রাখায় এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, গতকাল দুপুরে ঢাকা জেলা যুবদলের নেতা ও সাভার পৌরসভার তিন নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর খোরশেদ আলম দলীয় নেতা-কর্মীদের নিজ বাসভবনে জমায়েত করে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেন। এ সময় টহল পুলিশ বিষয়টি জানতে ঘটনাস্থলে গেলে যুবদলের নেতা-কর্মীরা তাদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠিচার্জ করার পাশাপাশি টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। পুলিশের সঙ্গে যুবদল নেতা-কর্মীদের দফায় দফায় চলা সংঘর্ষের সময় বেশ কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। এতে তিন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ২৫ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া ঘটনাস্থল থেকে তিনটি ককটেল ও দেশি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। খবর পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে অবস্থান নিয়েছে। তারা যুবদল নেতা খোরশেদের বাড়ি ঘেরাও করে রেখেছে। অন্যদিকে লাঠিসোঁটা নিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়েছেন যুবদল নেতা-কর্মীরা। সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী মাইনুল ইসলাম জানান, দেশি অস্ত্র ও ককটেলসহ ৩০ জনকে আটক করা হয়েছে। আটকদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে।