শীর্ষ নিউজ

বিশ্ব নদী দিবস ভাল নেই যশোরের নদ নদী


মালিক উজ জামান, যশোর : ২৫ সেপ্টেম্বর আজ বিশ্ব নদী দিবস। তবে ভাল নেই যশোরের হাতে গোনা কয় নদী। কপোতাক্ষ, ভৈরব, বেতনা, মুক্তেশ্বরী, হরিহর কোথাও হয়েছে বিলীন। আবার কোথাও জবর দখলে সে তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। সরকারের আন্তরিকতায় নদী খননেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা।
কাগজে কলমে যশোরে আছে কপোতাক্ষ নদ, ভৈরব নদ, হরিহর নদ এবং কোদলা, ইছামতী, হাকর, বেতনা অথবা বেত্রবতী অথবা বেত্রাবতী, মুক্তেশ্বরী, কাজলা, চিত্রা, শ্রী, টেকা, হরি, ভদ্রা ও আতাই নদী। এর মধ্যে মহাকবি মাইকেলের কপোতাক্ষ নদ বিশ্ব সমাদৃত এক নাম। তবে আগেই সে তার পরিচ্ছন্ন পানি হারিয়েছে। দুই পাশের নাগরিক দখলের মহোউৎসবে সে এখন জ্বীর্ন শীর্ন এক খাল যেন। কোথাও কোথাও তাকে ব্যক্তি পর্যায়ে আটকে রেখে পুকুর রুপ দেওয়া হয়েছে। তাই নানা চায়ের দোকানে বসে আক্ষেপ করে নাতিকে বলছে ‘সে দিন কি আর আছেরে নাতি, কথায় কথায় ছাতু খেতি।’ কবি বলেছেন, ‘ছৈ তুলে দু দন্ড দেখবো মাছের খেলা, ছুমছাম নিরবতা ভেঙ্গে দেখি পোলাপানের ভেলা।’ এসব এখন স্মৃতিময় অতীত। ছৈ তোলা নৌকা আর কপোতাক্ষে দেখা যায়না। যাবেই বা কি করে। পানি নেই, পানির রঙের ঐতিহ্য হারিয়ে মাইকেলের বঙ্গ নদ কপোতাক্ষ এখন মরা খাল। শুধু কপোতাক্ষ নয়, যশোর শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা ভৈরবে নেই নদীর কোন চিহ্ন। এমনকি শহরতলীর পুলেরহাট এলাকা দিয়ে চলাচলকারী মুক্তেশ্বরী কে নদী বলবে এমন বুকের পাটা আছে কার। মনিরামপুর ও কেশবপুর দিয়ে প্রবাহিত হরিহর এবং চৌগাছা, ঝিকরগাছা ও শার্শা দিয়ে প্রবাহমান বেতনা এখন মৃত এক নদীর উপাখ্যান। কোথাও কোথাও তাকে বড় জোর ঘের বলা হয়। ছোট ছোট অপরিকল্পিত কালভার্ট নদী গুলোকে যশোরে আরো পঙ্গু করে দিয়েছে। এমনকি যশোর বেনাপোল মহা সড়কে ঝিকরগাছা বাজারে নদীর উপর এমন একটি ব্রীজ নির্মাণ করা হয়েছে যাকে বড় কালভার্ট আখ্যা দেওয়াটাই হয়তো সঠিক।
নানা কারণে বিপন্ন যশোরের নদ-নদী। পলি জমে নাব্য সংকটে অনেক নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। কোথাও নদীর পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে স্থাপনা। অপরিকল্পিতভাবে ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করায় হুমকির মুখে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে খননের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সে উদ্যোগের আওতায়, যশোরের কিছু নদ-নদী খনন শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বিশ থেকে পঁচিশ বছর আগেও যশোরের নদ-নদীগুলো ছিল স্রোতস্বিনী। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে ঐতিহ্যবাহী কপোতাক্ষ নদ, হরিহর, মুক্তেশ্বরী, বেতনা, ভৈরব, সাগরদাঁড়ি, চিত্রাসহ সবগুলো নদ-নদীর নাব্যতা কমেছে। অনেক নদী মরা খালে পরিণত হয়েছে। একসময় এসব নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন এলাকার মানুষ। কৃষি জমিতে সেচের পানিও পাওয়া যেত নদী থেকে। নদী নির্ভর যোগাযোগের সুবিধাও ছিল এলাকাবাসীর। নদ-নদীগুলোর বর্তমান অবস্থার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ছাড়াও স্থানীয় দখলদার ও মানুষের অসচেতনাতাকে দায়ি করছেন পরিবেশ আন্দোলন কর্মীরা। এর মধ্যে কপোতাক্ষ নদ, হরিহর, মুক্তেশ্বরী, বেতনা, ভৈরব, সাগরদাঁড়ির বিভিন্ন স্থানে খননকাজ শুরু করা হয়েছে বলে জানান, যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহীদুল ইসলাম। নদীর গতিপথে যাতে প্রভাব না পড়ে, সেজন্য আগামীতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের কথা জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই নির্বাহী প্রকৌশলী।
গঙ্গার শাখা নদী জলাঙ্গি থেকে উৎপত্তি ভৈরব নদের। মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, খুলনা হয়ে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে এ নদ। বৃটিশ শাসনামলে চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় নদীর তীরে চিনিকল নির্মাণ ও রেললাইন তৈরি করতে গিয়ে সংকীর্ণ করে ফেলা হয় ভৈরব নদকে। এরপর অপরিকল্পিত বাঁধ, কালভার্ট, সেতু নির্মাণের পাশাপাশি অবৈধ দখলের কারণে ধীরে ধীরে নাব্য হারাতে থাকে নদটি। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার মৃতপ্রায় এ নদে খনন কাজের উদ্যোগ নেয়। এরপর যশোরের চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুর থেকে নওয়াপাড়ার আফরাঘাট পর্যন্ত ৯৬ কিলোমিটার খনন কাজ শুরু হয়েছে।
কপোতাক্ষ ভৈরব নদীর শাখা নদী। ইছামতী নদী কুষ্টিয়াা জেলার দর্শনার কাছে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে একটি শাখা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে যা ভৈরব নামে পরিচিত। কোটচাঁদপুরের দক্ষিণে ভৈরব থেকে একটি শাখা বের হয়ে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে খুলনা জেলার পাইকগাছার কাছে শিবসা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ভৈরবের এ শাখাই কপোতাক্ষ। প্রকৃতপক্ষে, কপোতাক্ষের উৎপত্তি মাথাভাঙ্গা নদী থেকে। এ উৎপত্তি স্থলে মাথাভাঙ্গার একটি বিরাট বাঁক ছিল। নদীর পথ সংক্ষিপ্ত করার জন্য একটি খাল খনন করে মাথাভাঙ্গার মূল স্রোতের গতিপথ পরিবর্তন করা হলে মাথাভাঙ্গার সঙ্গে কপোতাক্ষের সংযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে ভৈরব থেকে মূল স্রোতধারা পায়। গঙ্গা নদীর সঙ্গে মাথাভাঙ্গা এবং মাথাভাঙ্গার সঙ্গে কপোতাক্ষের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় কপোতাক্ষের স্রোতধারা ক্ষীণ হয়ে পড়ে। বর্ষাকাল ছাড়া অন্যান্য সময় স্থানীয় বৃষ্টি এবং চোয়ানো পানিই এর প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়ায় এবং নদীটি অধিকাংশ স্থানেই নাব্যতা হারায়। গ্রীষ্মকালে ঝিকরগাছা উপজেলার কাছে নদীটি প্রায় শুকিয়ে যায়। তালা উপজেলার কাছে উঁচু পাড় দেখে অনুমিত হয় যে, এখানে নদী একসময় ৭৫০ মিটার প্রশস্ত ছিল; বর্তমানে প্রায় ১৭০ মিটার। চাঁদখালীর কাছে নদীটি প্রায় ৩০০ মিটার চওড়া। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড গঙ্গা থেকে পানি পাম্প করে এ নদীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করে এলাকায় জলসেচের ব্যবস্থা করেছে। এ প্রকল্পর নাম গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প। কপোতাক্ষের পানি যশোর জেলাতেও কোথাও কোথাও পাম্প করে সেচের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে পানি প্রবাহ সেচ কাজের জন্য যথেষ্ট নয়। কপোতাক্ষ নদ এবং এর শাখা-প্রশাখা দিয়ে কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনার প্রায় ৩,৩১৫ বর্গ কিমি এলাকার পানি নিষ্কাশিত হয়। নদীটি খুলনা জেলার প্রায় সর্বত্রই নাব্য এবং লঞ্চ চলাচলের ব্যবস্থা আছে। নদীর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬০ কিমি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button