যশোর থেকে ঢাকা বাস ভাড়া ৪৪৪ টাকা যাত্রীর কাছ থেকে আদায় ৬৫০ টাকা
মালিক উজ জামান, যশোর : গত ১০ অক্টোবর মধুমতী নদীর ওপর দেশের প্রথম ছয় লেনের মধুমতী সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। লোহাগড়া উপজেলার মধুমতী নদীর অংশে এ সেতু নির্মাণে কমেছে যশোর-নড়াইলের দূরত্ব ১১৩ কি:মি:।
যাতয়াতে প্রত্যাশিত সুবিধা থেকে বঞ্চিত যশোর অঞ্চলের মানুষ। রয়ে গেছে ভাড়া না কমার ইস্যু। অপ্রশস্ত রাস্তায় আছে দুর্ঘটনার শঙ্কা। কিছুদিন আগেও নড়াইল-যশোর থেকে ফরিদপুর-পাটুরিয়া ঘাট হয়ে রাজধানীতে ঢুকতো যশোর-নড়াইলের ঢাকাগামী পরিবহনগুলো। এ রুটে নড়াইল থেকে দূরত্ব ছিলো ২২৫ কিলোমিটার, যশোর থেকে ২১২ কি:ামি:। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা-মধুমতী সেতু হয়ে নড়াইলের দূরত্ব ছিলো ১৩৯ কি:মি:, যশোরের ১৭০ কি:মি:। সেতু হওয়ার পর নড়াইলের দূরত্ব কমেছে ৮৬ কি:মি:। যশোরের দূরত্ব কমলেও এ রুটে বাস ভাড়া কমেনি। এ রুটে প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ২ দশমিক ২০ টাকা করে ধরলে নড়াইল পর্যন্ত ভাড়া আসে ৩০৫ টাকা। এর সঙ্গে পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ে ও মধুমতী সেতুর টোল যোগ করলে ভাড়া দাঁড়ায় ৩৭৫ টাকা। অর্থাৎ, টোল দিতে হয় ৭০ টাকা। পথ কমে যশোরের দূরত্ব ১৭০ কি:মি: হওয়ায় ভাড়া হবে ৩৭৪ টাকা। সেতু-এক্সপ্রেসওয়ের টোল ৭০ টাকা যোগ হলে ভাড়া ৪৪৪ টাকা। কিন্তু যশোর থেকে পরিবহন ভাড়া নিচ্ছে ৬৫০ টাকা করে। অর্থাৎ, পরিবহন ২০০ টাকা বেশি ভাড়া আদায় করছে।
যাত্রী অভিযোগ, তেলের দাম বৃদ্ধির পরে থেকে যশোর থেকে পাটুরিয়া হয়ে ঢাকাগামী রুটে ৬৫০ টাকা নেয়া হচ্ছিলো। মধুমতী সেতু চালু হওয়ার পর পথ ৪০ কিলোমিটার কমলেও আগের ভাড়াই নেয়া হচ্ছে। আগে ঢাকা থেকে ৬ ঘণ্টা সময় লাগতো যশোরে। মধুমতী ও পদ্মা সেতু হওয়ায় সময় প্রায় তিন ঘণ্টা কমে গেছে। সময় কমে গেলেও ২০০ টাকার বেশি ভাড়া আদায় অত্যাচারের শামিল। পরিবহন মালিকদের এমন অনৈতিক কর্মে যাত্রীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এ রুটে চলাচলকারী নড়াইল এক্সপ্রেসের বাস ভাড়া ৪৫০ টাকা। যশোর-ঢাকা রুটে আগের ভাড়া আদায়ের কথা স্বীকার করেন যশোর সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি ও ঈগল পরিবহনের সত্তাধিকারী পবিত্র কাপুড়িয়া। তিনি জানান, আগের ৬৫০ টাকা ভাড়া নেয়া হচ্ছে। এটি সরকার নির্ধারিত। যশোর-নড়াইল-ঢাকা রুটে মধুমতী সেতুসহ আরো কয় সেতুর ও এক্সপ্রেসওয়ের টোলের কারণে পরিবহনে এ ভাড়া রাখা হয়েছে। নড়াইল জেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী জহির পরিবহনের সংখ্যা বাড়লে এ রুটে ভাড়া কমার আশ্বাস দিয়েছেন। সেতু হওয়ায় ঢাকা থেকে যশোর-নড়াইল রুটে পরিবহন চাপ বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে দুর্ঘটনার শঙ্কা। কারণ, অপ্রশস্ত রাস্তা। নড়াইলের পরিবহন সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, আগে কালনা ফেরি হয়ে এ রটে শুধু দিগন্ত পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, ঈগল পরিবহন, একে ট্রাভেলস ও নড়াইল এক্সপ্রেসের বাস চলাচল করতো। নড়াইল এক্সপ্রেসের ট্রিপ চলতো ২৫, ঈগলের ১৩টি। সেতু চালুর পর এখন ২৪ ঘণ্টায় নড়াইল এক্সপ্রেস ট্রিপ চলে ৮০টি। ঈগল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা নড়াইল থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ৭২টি বাস ছাড়ার প্রস্ততি নিয়েছে। এ ছাড়া সোহাগ পরিবহন, দেশ ট্রাভেলস, আপন পরিবহন, শিবচর ডিল্যাক্স, একে ট্রাভেলসসহ ২৫ কোম্পানির বাস চলছে মধুমতী সেতু দিয়ে। এতদিন কালনা ও মাওয়া ফেরির কারণে এ রুটে বিলাসবহুল বাস চলেনি। এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে সেটিও।
এ বিষয়ে নড়াইল ঈগল পরিবহন ম্যানেজার বিলাল হোসেন জানান, যশোর-বেনাপোল ও নড়াইল থেকে আগে ২৪ ঘণ্টায় ১৩টি গাড়ি চলতো। কালনা ফেরিতে এতদিন নড়াইল থেকে কোনো লাক্সারি বাস ঢাকায় যেতো না। মধুমতী সেতু হওয়ায় নড়াইল লাক্সারি বাসসহ ২৪ ঘণ্টায় ৭২টি গাড়ি নড়াইল থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। নড়াইল জেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী জহির জানান, নড়াইল থেকে আগে মাত্র ৩টি কোম্পানির বাস যেতো ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে। মধুমতী সেতু হওয়ায় নতুন আরো ৫টি পরিবহন কোম্পানি নড়াইলে কাউন্টার নিয়েছে। এ রুটে পরিবহনের সংখ্যা দ্রুত বাড়বে। এর ফলে যাতায়াতে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আছে রুটের কিছু অপ্রশস্ত রাস্তা। এর মধ্যে একটি মধুমতি সেতু থেকে যশোরের মণিহার মোড় পর্যন্ত রাস্তাটি। এ পথের দূরত্ব ৬০ কি:ামি:। কিন্তু অতিরিক্ত যানবাহন চলাচলে অনুপযুক্ত। সংশ্লিষ্টরা জানন, এখন দিন-রাত এত বেশি বাস চলাচল করছে, দুর্ঘটনা হতে পারে যেকোনো সময়। কারণ অপ্রশস্ত রাস্তা এমন, ১টি বাস অপরটিকে ওভারটেক করে যাওয়ার মতো নয়। দুই লেনের রাস্তা বলা হলেও আদতে তা নয়। দুই লেনের রাস্তার আন্তর্জাতিক মান ২৪ ফুট হলেও এ সড়ক মাত্র ১৮ ফুটের। ফলে সাবলীলভাবে এ রাস্তায় দুইদিক দিয়ে দুটি পরিবহন চলতে পারে না।
এ ছাড়া সেতুতে ভ্যান-রিকশা-ইজিবাইক চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এসব হালকা যান দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এ রুটে নিয়মিত যাতায়াতকারী যাত্রীরা বলছেন, পরিবহনের সংখ্যা বাড়ায় দুর্ঘটনার শঙ্কা বাড়ছে। কারণ, কিছু সড়ক ভারী পরিবহন চলাচলের উপযুক্ত নয়। বাহনগুলোও দ্রুত যেতে পারে না। তাই সময় বাঁচবে কথাটি বলা হলেও অনেকাংশে সত্য নয়। যশোর পর্যন্ত যেতে এখন সোয়া তিনঘণ্টা সময় লাগলেও রাস্তা প্রশস্ত থাকলে আরো ৩০-৪০ মিনিট সময় সাশ্রয় হতো।
ভাঙ্গা থেকে যশোর হয়ে বেনাপোল পর্যন্ত ৬ লেনের রস্তার কাজ এ বছর শুরু হবে। শেষ হতে সময় লাগবে অন্তত ৫ বছর। সড়ক নির্মাণ কর্মকর্তারা এ আশা করলেও শঙ্কার কথাও জানান তারা। শঙ্কা মূলত সময়ক্ষেপণ নিয়ে। সড়ক নির্মাণে সময় যত বেশি গড়াবে তত বেশি ভোগান্তি বাড়বে। নড়াইলের সড়ক বিভাগ জানিয়েছে, ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল জাতীয় মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীতকরণে ১১০০০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি হয়েছে। রোডের নকশার কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে আছে পাঁচটি ফ্লাইওভার। নড়াইল ও যশোর অংশে পৃথক দুটি বাইপাস হবে। প্রকল্পের মধ্যে নড়াইল শহরের বাইপাস সড়কও রয়েছে। আপাতত, কালনা থেকে যশোর পর্যন্ত দুই পাশে ৩ ফুট চওড়া করার কাজ চলছে। শহর বাইপাস এলাকায় ৩ ফুট রাস্তা বেড়ে হবে ১৮ ফুট। নড়াইল সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুজ্জামান জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল জাতীয় মহাসড়ককে ৬ লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজ অনুষ্ঠানিক চলমান। আপাতত চাপ সামলাতে কালনা থেকে যশোর পর্যন্ত বর্তমান সড়ক আরো ছয় ফুট পিচ ঢালাই করে চওড়া করা হবে। দেড় বছরের মধ্যে এর কাজ শেষ হবে।