বৈশ্বিক বিবিধ সংকটের মধ্যেও নির্ধারিত সূচি অনুযায়ীই ঈশ্বরদীর রূপপুরে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটের মূল যন্ত্র রিয়্যাক্টর প্রেসার ভেসেল বা পরমাণু চুল্লিপাত্র স্থাপন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রেসার ভেসেল স্থাপন কাজের উদ্বোধন করেন।
আজ বুধবার সকাল ১০ টা ৩৪ মিনিটে প্রেসার ভেসেল স্থাপনের অনুমতি দেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সংযুক্ত হন।
এর মধ্য দিয়ে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারকারী দেশের তালিকায় আরেক ধাপ অগ্রগতির পথে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র। বর্তমানে বিশ্বে মোট ৩৩টি দেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। বাংলাদেশ আগামী বছরের শেষের দিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট উৎপাদনে যাবে। তবে সেটি থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ কবে যাবে, তা নির্ভর করবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) কবে নাগাদ সঞ্চালন লাইন বসাবে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি করপোরেশন-রোসাটমের মহাপরিচালক অ্যালেক্সি লিখাচেভ ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রাণালয়ের সিনিয়র সচিব জিয়াউল হাসান বক্তব্য দেন।
রিয়্যাক্টর ভবনের ভেতর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে রূপপুর প্রকল্পের পরিচালক ও পরমাণু বিজ্ঞানী ড. শৌকত আকবর, রিয়্যাক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপনের অনুমতি চান। প্রধানমন্ত্রী অনুমতি দিলে, রিয়্যাক্টর ভেসেলটি নকশা অনুযায়ী যথাস্থানে বসানো হয়। ৫ থেকে ৬ মিনিটের মধ্যে এটি বসানো শেষ হলে জয় বাংলা, জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে রিয়্যাক্টর ভবন থেকে অনুষ্ঠানস্থল। এর আগে গত বছরের ১০ অক্টোবর প্রথম ইউনিটের রিঅ্যাক্টর প্রেশার ভেসেল স্থাপন কার্যক্রমের উদ্বোধন করেছিলেন তিনি।
রাশিয়ার কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় নির্মিত হচ্ছে রূপপুর প্রকল্প। এই প্রকল্পের দ্বিতীয় ইউনিটে যে রিয়্যাক্টর স্থাপন করা হলো সেটিও রাশিয়ার তৈরি সর্বশেষ প্রযুক্তি থ্রিজি প্লাস প্রজন্মের ভিভিইআর ১২০০ মডেলের।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যে যন্ত্রে নিউক্লিয়ার ফুয়েল (পারমাণবিক জ্বালানি) ইউরেনিয়াম থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় তার মূল কাঠামো হচ্ছে এই বিশেষ যন্ত্র অর্থাৎ রিয়্যাক্টর প্রেসার ভেসেল (পরমাণু চুল্লি)। এই রিয়্যাক্টরকে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের হার্ট বা হৃৎপিণ্ড বলা হয়।
পারমাণবিক প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা-ইন্টারন্যাশনাল এ্যাটমিক এ্যানার্জি অ্যাসোসিয়েশনের (আইএইএ) গাইড লাইন অনুযায়ী এবং সংস্থাটির কড়া নজরদারির মধ্য দিয়েই রূপপুর প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে।
১৯৬১ সালে পাবনার এই রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেই উদ্যোগ আর বেশিদূর আগায়নি। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রূপপুরে ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) সফরের সময় দেশটির তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নুপুরকে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সহযোগিতার অনুরোধ করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই প্রক্রিয়া থেমে যায়। দীর্ঘদিন পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ডক্টর এম এ ওয়াজেদ মিয়া। এরপর প্রক্রিয়া আগাতে থাকলেও ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর এই কার্যক্রম আবার হোঁচট খায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পুনরায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কার্যক্রম শুরু করে। পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা হয়। ২০২১ সালে রাশিয়ার সঙ্গে এ বিষয়ে বাংলাদেশের চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এরপর প্রক্রিয়া আরও এগিয়ে যায়।
স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরের মধ্যে রূপপুর প্রকল্পই দেশের সবচেয়ে বড় এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে সর্বাধিক ব্যয়বহুল প্রকল্প। ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচের এই প্রকল্পে ৯০ ভাগ টাকা ঋণ দিয়েছে রাশিয়া। একইসঙ্গে আন্তঃরাষ্ট্রীয় কয়েকটি চুক্তির মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করছে রূশ ঠিকাদার এটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট।