আঞ্চলিকশীর্ষ নিউজ

যশোরে এহসানএস প্রতারণা ধুকে ধুকে করুণ মৃত্যু ৬০ জনের


মালিক উজ জামান, যশোর : এক টাকাও ফেরত পাননি দৈন দশায় পড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান এহসানএস বাংলাদেশ ও এহসান মাল্টিপারপাসের যশোর অঞ্চলের গ্রাহকেরা। প্রতারক চক্রের হালাল উপার্জনের টোপ গিলে বছরের পর বছর অসহায়ের মত জীবনযাপন করছেন এসব লগ্নিকারী গ্রাহক। সংঘবদ্ধ প্রতারকদের বিরুদ্ধে মামলা চালিয়ে ক্লান্ত সর্বশেষ ৩ জনের করুন মৃত্যু হয়েছে।
আগে মারা গেছেন প্রতারণার শিকার ৫৭ জন। খপ্পরে পড়ে সারা জীবনের সঞ্চয় ওই চিহ্নিতদের হাতে তুলে দিয়ে শেষ জীবনে অর্থাভাবে ওষুধ কিনতে পারেননি তারা। প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান তারা। সর্বশেষ মারা যাওয়া তিনজন হচ্ছেন যশোর শহরের কারবালা এসপি বাংলোর সামনের শামসুর রহমান, শহরতলীর ঝুমঝুমপুরের রহিমা বেগম ও আম্বিয়া খাতুন। পাশাপাশি প্রায় ২০০+ ভুক্তভোগী লাগ্নিকারী এখন রোগেশোকে বিছানায় শয্যাশায়ী। এক সময় অর্থ বৈভবের মালিক থাকলেও প্রতারকদের কারণে আজ তাদের জীবন চলছে ফকিরের হালে। কারো ওষুধ কেনার টাকা নেই, কারো ঠিকমত খাদ্য জুটছে না, পরনির্ভর হয়ে চলতে হচ্ছে তাদের। প্রতারকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহলে আকুতি জানিয়ে আজ ক্লান্ত তারা। দৈনদশায় পড়ে করুণ জীবনযাপন চলছে তাদের।
২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল সময়। বিনা সুদে হালাল উপার্জনে লাখে ১৬০০ টাকা মুনাফার প্রলোভনে যশোরাঞ্চলের ২০ সহস্রাধিক লগ্নিকারী বন্দি হয়ে পড়েন মাল্টিপারপাসের জালে। এহসান গ্রুপের এহসান এস বাংলাদেশ ও রিয়েল এস্টেট, এহসান মাল্টিপারপাসের প্রতারকেরা মাঠে ছিলেন। ধর্মভীরু বৃদ্ধা বদ্ধকে টার্গেট করেন। যশোরাঞ্চলে ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেম, মাদ্রাসা শিক্ষক মিলিয়ে ১০৮ মাঠ কর্মীকে কাজে লাগিয়ে টার্গেট দেয়া হয়। ওই ফাঁদে পা দিয়ে চাঁচড়ার রাজা বরদাকান্ত রোডের মৃত আব্দুল হকের স্ত্রী আম্বিয়া ১৪ লাখ টাকা টাকা, ঝুমঝুমপুর মুক্তিযোদ্ধা কলোনীর মৃত আব্দুস সামাদের স্ত্রী রহিমা খাতুন ১৩ লাখ টাকা, রুপদিয়ার মৃত শের আলীর ছেলে নুর ইসলাম ১৪ লাখ টাকা, বাঘারপাড়া ঘোষ নগরের শরৎ চন্দ্রের স্ত্রী শেফালী রানী শীল ১৬ লাখ টাকা, একই গ্রামের সূব্রত অধিকারীর স্ত্রী দূর্গা রানী অধিকারী ৫ লাখ টাকা, পুরাতন কসবার আফসার আলী ১২ লাখ টাকা তুলে দেন প্রতারক চক্রের হাতে। এরা ছাড়াও যশোরাঞ্চলের ১৬ থেকে ২০ হাজার গ্রাহক ৩২২ কোটি টাকা লগ্নি করেন বাড়ির সবর্স্ব খুঁইয়ে। ওই টাকা লগ্নি করে আজ তারা চরম অর্থাভাবে দীর্ঘ ৮ বছর সময় কাটাচ্ছেন। এদের মধ্যে সম্প্রতি মারা গেছেন এসপি বাংলোর সামনের শামসুর রহমান, ঝুমঝুমপুরের রহিমা বেগম ও আম্বিয়া খাতুন। মামলা চালাতে চালাতে ক্লান্ত ছিলেন তারা। পরে রোগে শোকে হয়ে পড়েন শয্যাশায়ী। নিজের টাকা পরকে দিয়ে ঠিকমত ওষুধ পথ্য ও দু’বেলা খাবার জোটেনি শেষে। পরনির্ভরশীল হয়ে মানবেতর জীবনযাপনের মারা গেছেন তারা। সূত্র জানায় এহসান এসের তিন প্রতিষ্ঠান সর্বমোট প্রায় ১৮ থেকে ২১ শত কোটি টাকা উঠায় পাবলিক খাত থেকে। যশোরাঞ্চলের ১৬০০০ লগ্নিকারীর পক্ষে দায়ের করা মামলায় এহসান গ্রুপের এহসান এস বাংলাদেশ ও রিয়েল এস্টেটের চেয়ারম্যান নামধারী চট্টগ্রামের মুফতি আবু তাহের নদভীসহ যশোর ও ঢাকার ৩০/৪০ জনকে আসামি করা হলেও তারা টাকা ফেরত দেয়ার ব্যাপারে এগিয়ে আসেননি। উল্টো গা ঢাকা দেয়ায় প্রতারকদের কঠিন শান্তি ও পরিনাম দেখতে চান মারা যাওয়া লগ্নিকারীদের স্বজনেরা।
টাকা লগ্নি করে এখন করুন জীবনযাপন করছেন যশোর সদরের হামিদপুরের কামরুজ্জামান, রূপদিয়ার শের আলী, বারান্দীপাড়ার বিধবা আমিরুননেছা, কুলসুম বেগম, পুরাতন কসবা মিশনপাড়ার আফসার উদ্দিন, সীতারামপুরের আবুল কালাম, বালিয়া ভেকুটিয়া এলাকার মোহাম্মদ হানিফ, রাজারহাটের শাহাজাদী বেগম, বারান্দীপাড়ার আলেয়া বেগম, পূর্ববারান্দী মাঠপাড়ার নাছিমা খাতুন, একই এলাকার রায়হানুল ইসলাম, নাজির শংকরপুর এলাকার তরিকুল ইসলামের পরিবারে। তাদের মধ্যে অনেকে এখন বিছানায়। ঐ লগ্নিকারী ও তাদের পরিবারের লোকজন এখনও পথ চেয়ে আছেন ঐ টাকা ফেরতের আশায়। এহসানের টাকায় হজ করতে চেয়েছিলেন পুরাতন কসবার আফসার আলী। এখন তিনি প্যারালাইজড। তিনি জানান, এক নিটক আত্মীয়ের মহানুভবতায় তিনি ওষুধ কিনছেন। কিন্তু কতদিন চলবে এভাবে? তার ১০ লাখ টাকা লগ্নিছিল। বারান্দীপাড়া কদমতলার রবিউল ইসলাম, শাখারিগাতীর আবদুল জলিলসহ আরো অনেকে এখন শয্যাশায়ী। হজ্বে যাওয়া হয়নি শামসুর রহমানের। মৃত শামসুর রহমানের স্ত্রী আলেয়া খাতুন ও ভাগ্নি তাসলিমা বেগম জানান, ৫ লাখ টাকা দেয়া ছিলো তাদের। টাকা ফেরত পাননি। অনেকটা বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মারা গেছেন শামসুর রহমান। এখন পরিবারের লোকজন নিয়ে স্যাঁতসেতে ঘরে ভাড়া থাকেন। অথচ মুসলিম একাডেমির কেরানীর কাজে পাওয়া তার জীবনের শেষ সম্বল লগ্নি রয়েছে প্রতারকদের কাছে।
মৃত মোমিনুল ইসলামের স্ত্রী নুর জাহান বেগম, ছেলে মাসুদ আহমেদ, পুত্র বধূ রিক্তা বেগম জানান, ছোট একটি ব্যবসা নষ্ট করে ৪ লাখ টাকা দিই। আয় দুরের কথা, মূল টাকা পাননি তারা। মোমিনুল ইসলামের টাকার অভাবে ঠিকমত ওষুধ জোটেনি। শেষমেশ মারা গেছেন। তার পরিবারেও সেই অর্থ শুণ্যতা এখন। একই অবস্থা মারা যাওয়া লগ্নিকারী ভেকুটিয়ার জয়নাল আবেদীন, বজলুর রহমান, পূর্ববারান্দীপাড়ার আবু কাওছার, নূরজাহান বেগমের। তাদের বাড়ি ও পরিবারে করুন চিত্র। মৃত রেলগেটের আব্দুল গফুর, রুপদিয়ার আলী গাজী, মুড়লি খাঁ পাড়ার গনি মিয়া ও কাজীপুরের জব্বার আলীর পরিবার পরিজন চরম আর্থিক কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। মোমিনুল ইসলামের পুত্র মাসুদ জানান, টাকা থেকেও বাবা কষ্ট করে গেছেন।
এহসানের ক্ষতিগ্রস্ত লগ্নিকারী সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক বারান্দীপাড়া কদমতলার মফিজুল ইসলাম ইমন জানান, দীর্ঘ ৯ বছর প্রতারকদের সাথে লড়াইয়ে ভুক্তভোগীরা। মানুষের বিশ^াসের সুযোগ নিয়ে ইসলামী আদর্শের সাথে বেঈমানী করে শত শত কোটি টাকা পকেটে নিয়ে অধিকাংশ প্রতারকই ঘুরছে। ই-ভ্যালি প্রতারণার শিকার গ্রাহকদের পাশে সরকার দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ২০০৮ সাল থেকে প্রতারণা করা এই চক্রের ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগ নেই। সমবায় অফিসে গেলে বলা হচ্ছে তাদের কিছু করার নেই। তিনি ই-ভ্যালির মত প্রতারণার শিকার এহসান গ্রাহকদের ভর্তূকি ও ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগ দাবি করেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button