পারকিতে নিম্নমানের সামগ্রী ও লবণাক্ত পানি দিয়ে মেগা প্রকল্পের কাজ, হেলে পড়েছে সীমানা প্রাচীর
চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর পারকি সমুদ্র সৈকতকে অত্যাধুনিক পর্যটন স্পট গড়তে পর্যটন কর্পোরেশনের উদ্যোগে ১৩ দশমিক ৩৬ একর জমিতে ৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে বিশ্বমানের পর্যটন কমপ্লেক্স নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী, সাগরের লবণাক্ত বালি ও পানি ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মাঝে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তবে নিম্নমানের সামগ্রী, সাগরের লবণাক্ত বালি বা লবাণক্ত পানি ব্যবহার হয়েছে— এমন অভিযোগ মানতে নারাজ কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, পর্যটন মন্ত্রণালয় পারকি সমুদ্র সৈকতকে আধুনিক বিচ ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পর্যটন কর্পোরেশন তিন বছর মেয়াদি পারকি বিচে পর্যটন সুবিধাদি প্রবর্তন নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়। ২০১৮ সালে ১৩ দশমিক ৩৬ একর জমিতে ৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ নিয়ে শুরু হয় পর্যটন কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ। প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ছিল ২ বছর। তিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে কাজ করেও ২০ শতাংশ কাজও শেষ করতে না পারায় মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। আর বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয় ৭১ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
কিন্তু মেয়াদ বরাদ্দ দুইটি বাড়িয়েও ৬০ শতাংশ কাজও শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ প্রকল্পের বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন। যদিও কর্তৃপক্ষ ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে দাবি করলেও মুলত কাজ শেষ হয়েছে ৫০ শতাংশ। অপরদিকে নির্মাণ কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ও সাগরের লবনাক্ত বালি আর পানি ব্যবহারের কারণে গুণগতমান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয়রা।
সরজমিনে পারকি সৈকতে গিয়ে দেখা যায়, এ প্রকল্পের ১৪টি আধুনিক কটেজের মধ্যে ১০টি তৈরী করা হলেও ৪টির কাজ এখনও শুরু হয়নি। চারতলা বিশিষ্ট মাল্টিপারপাস ভবনের কাজও বাকি। ব্যাচেলর সার্ভিস রুম, কমপ্লেক্সের সার্ভিস রুম, ওয়াশরুম ব্লক, লেক, ঝুলন্ত ব্রিজ, পিকনিক শেড, কুকিং শেড, খেলার মাঠ এসবের কাজও শুরু হয়নি। বিশাল এ কর্মযজ্ঞের মধ্যে ৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কাজ করছেন একটি মাত্র ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের ১৫ জন শ্রমিক। চারিদিকে সীমানা প্রাচীরের কাজ শেষের পথে। প্রকল্পের পশ্চিম পাশে একটি মৎস্য খামার থেকে মোটর বসিয়ে তোলা হচ্ছে লবাণক্ত পানি।
পর্যটন কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, ১৩ দশমিক ৩৬ একর জমিতে ৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন বছর মেয়াদি পারকি বীচ পর্যটন সুবিধাদি প্রবর্তন নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়াজ ট্রেডার্স, দেশ লিংক লিমিটেড ও রাজ কর্পোরেশন যৌথভাবে এ কাজ শুরু করে এ প্রকল্পের মধ্যে মোট ১৭টি স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। ১৪টি আধুনিক কটেজ রয়েছে। এরমধ্যে ৪টি ডবল ডুপ্লেক্স কটেজ এবং ১০টি সিঙ্গেল কটেজ। ৪র্থ তলাবিশিষ্ট একটি মাল্টিপারপাস ভবন। গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকবে পর্যটন অফিস, দ্বিতীয় তলায় থাকবে দুইটি দোকান, একটি রেষ্টুরেন্ট, তৃতীয় ও ৪র্থ তলায় থাকবে ২টি বার, একটি ২৫০ আসনের কনভেনশন হল। তৃতীয় তলাবিশিষ্ট ১টি সার্ভিস ব্লক, যেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের থাকার বিশেষ ব্যবস্থাসহ পর্যটকদের জন্য সিঙ্গেল ব্যাচেলর সার্ভিস রুম ৩৫টি, কমপ্লেক্সের সার্ভিস স্টাফদের জন্য ৪৪টি রুম থাকবে। একটি ওয়াশরুম ব্লক, যেখানে নারী-পুরুষদের জন্য আলাদা আলাদা ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া একটি লেক, একটি ঝুলন্ত ব্রিজ, দুইটি পিকনিক শেড, কুকিং শেড। একটি খেলার মাঠ, যার মধ্যে ভলিবল, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন খেলার ব্যবস্থা থাকবে এবং গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধাও রাখা হবে। প্রত্যেকটি ভবনের সামনে সাজানো বাগান থাকবে। পারকিতে আধুনিক পর্যটন কমপ্লেক্স বাস্তবায়ন হলে পারকি বিচ হবে দেশের অন্যতম একটি পর্যটন কেন্দ্র।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, আনোয়ারা-কর্ণফুলীর সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর প্রস্তাবে ৯ বছর আগে চট্টগ্রামের একটি জনসভায় পারকি সমুদ্র সৈকতকে আধুনিক পর্যটন শিল্প এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে অনুযায়ী ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপির প্রচেষ্টায় পারকি সৈকতে শুরু হয়েছে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রাজ কর্পোরেশনের স্বত্তাধিকারী সুজন সিংহ বলেন, আমরা গত তিনমাস আগে চারিদিকে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের কাজ পেয়েছি। কিছুদিনের মধ্যে আমাদের কাজ শেষ হয়ে যাবে। আমাদের কাজের মধ্যে কোন ধরণের নিম্নমানের সামগ্রী বা লবাণক্ত বালি পানি ব্যবহার করা হয়নি।
নির্মাণ কাজ ধীরগতি ও প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে পর্যটন কর্পোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী অসীম শীল বলেন, প্রকল্পের কাজের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। করোনার কারণে নির্মাণ কাজে একটু ধীরগতিতে হয়েছিল। নির্মাণকাজে নিম্নমানের সামগ্রী, সাগরের লবাণক্ত বালি আর পানি ব্যবহারের বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে নিম্নমানের সামগ্রী, সাগরের লবণাক্ত বালি বা লবাণক্ত পানি ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। আমরা প্রতিনিয়ত কাজের গুণগতমান পরীক্ষা নিরীক্ষাসহ সার্বক্ষনিক নজরদারিতে রাখছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ জোবায়ের আহমেদ বলেন, পর্যটন কর্পোরেশনকে জমি বুঝিয়ে দেওয়ার পরই তারা একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে।ঠিকাদারের অবহেলার কারণে এখনও সম্ভব হয়নি। বিষয়টি আমি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তিনি আরও বলেন, নির্মাণ কাজে যদি কোনো অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।
হেলে পড়েছে পর্যটন কমপ্লেক্সের গাইড ওয়াল
এদিকে পর্যটন কমপ্লেক্সের নির্মাণাধীন গাইড ওয়াল উদ্বোধনের আগেই হেলে পড়েছে। যে কোনো সময় তা ধসে পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা দেখা দেওয়ায় জনমনে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। নির্মাণকাজে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণেই এমনটি হয়েছে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গাইড ওয়াল রক্ষায় কাজ করেন কয়েকজন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক। আর এতে সমুদ্রের পানিযুক্ত বালুর চাপে হেলে পড়েছে গাইড ওয়াল। তবে নির্মাণ কাজে নিয়োজিত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান দেশ লিংক ও রাজ কর্পোরশন গাইড ওয়ালের নির্মাণ কাজের বিষয়ে অস্বীকার করেন।
জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স দেশ লিংকের স্বত্তাধিকারী মাসুদ আলম বলেন, আমরা কটেজ ও মাল্টিপারপাস ভবনের কাজ পেয়েছি। কোনো গাইড ওয়াল নির্মাণের কাজ করেনি। গাইড ওয়ালের কাজ করেছেন রাজ কর্পোরেশন নামে একটি ঠিকাদার। কাজ বন্ধ রাখার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভবনের নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে। যে ভবন গুলো তিনতলা ছিলো এ গুলো ৫ তলা হবে। সে জন্য কাজ একটু ধীরগতিতে চলছে। মেয়াদ আবারও ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এরমধ্যে কাজ শেষ হবে বলে তিনি দাবী করেন।
তবে রাজ কর্পোরেশনের স্বত্তাধিকারী সুজন সিংহ আরও বলেন, গাইড ওয়ালের কাজ দেশ লিংক করেছেন। উদ্বোধনের আগে যখন গাইড ওয়াল ধসে যাওয়ায় তারা বিষয়টি অস্বীকার করছেন এখন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম পর্যটন কমপ্লেক্সের (বাপক) উপ ব্যবস্থাপক মো. সরওয়ার উদ্দিন বলেন, নিম্নমানের সামগ্রী ও লবণাক্ত পানি ব্যবহারের বিষয়টি আমাদের জানা ছিলনা। হয়ত এই কারণেই সীমানা প্রাচীর হেলে পড়েছে। বিষয়টি আমি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাচ্ছি এবং তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।