৩২ দলের বিশ্বকাপ এখন পরিণত হয়েছে মাত্র দুই দলের। বিশ্বকাপের সব উত্তেজনা থেমে যাবে আজ। নেমে যাবে ফুটবল বিশ্বযুদ্ধের আরো একটি আসরের পর্দা। ম্যাচ সংখ্যাও কমতে কমতে দাঁড়িয়েছে একটিতে। আর সে ম্যাচটি যে স্বপ্ন পূরণের। আবার স্বপ্ন ভাঙারও। ঠিক এই বাস্তবতা সামনে নিয়ে দুরুদুরু বুকে দাঁড়িয়ে আছে মেসির আর্জেন্টিনা এবং এমবাপের ফ্রান্স। বিশ্বকাপ জয়ের স্মৃতিটা ফ্রান্সের একেবারে তরতাজাই। কারণ তারা যে গত আসরের চ্যাম্পিয়ন। আর আর্জেন্টিনার স্মৃতিটাতে ধুলো জমে গেছে। কারণ মেসির দেশ বিশ্বকাপ জিতেছিল সেই ৩৬ বছর আগে। যখন আজকের সুপার স্টার এবং আর্জেন্টিনার স্বপ্ন সারথী মেসির জন্মও হয়নি। গত ৩৬ বছর ধরে আরেকটি শিরোপার জন্য হাহাকার করছে আর্জেন্টিনা। ফুটবলের ক্ষুদে জাদুকরের হাত ধরে এখন সেই কাঙ্ক্ষিত শিরোপা জয়ের একেবারে দ্বার প্রান্তে তারা। ১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনা ম্যাজিকে বিশ্বকাপ জিতেছিল আর্জেন্টিনা। আর ২০২২ সালে এসে আরেক ম্যাজিক ম্যান লিওনেল মেসির হাত ধরে ৩৬ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটাতে চায় আর্জেন্টিনা।
লিওনেল মেসির হাত ধরে আর্জেন্টিনা যেন অপ্রতিরোধ্য এক দল। অন্তত এবারের বিশ্বকাপে তেমনটাই বলে। সৌদি আরবের বিপক্ষে অপ্রত্যাশিত এক হার দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করা আর্জেন্টিনাকে আর থামানো যাচ্ছে না। তবে আলভেসেলেস্তাদের এই অপ্রতিরোধ্য যাত্রায় নেতৃত্ব দিচ্ছে লিওনেল মেসি। নিজে খেলছেন আবার সতীর্থদের খেলাচ্ছেন। নিজে গোল করছেন আবার সতীর্থদের দিয়ে করাচ্ছেন। এবার যাদুকরের স্বপ্ন পূরণের পালা। যে স্বপ্নের দুয়ার থেকে মেসি ফিরে এসেছেন সেই ২০১৪ সালে। এবার আরো একবার সেই স্বপ্ন দুয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে মেসি এবং তার দল। এখন কেবল চাবি দিয়ে দরজা খুলতে বাকি।
বিশ্বকাপ ফাইনালে আজ রাতে মুখোমুখি হওয়ার আগে বলা যায় ফ্রান্স এবং আর্জেন্টিনা যেন একই সরল রেখায় দাঁড়িয়ে। কাতার বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে দুদলই একটি করে ম্যাচ হেরেছে। যেখানে আর্জেন্টিনা হেরেছে শুরুরটা, আর ফ্রান্স হেরেছে শেষেরটা। দুদলই হেরেছে দুটি একেবারে অপ্রত্যাশিত দলের কাছে। আর্জেন্টিনা ধাক্কাটা খেয়েছিল সৌদি আরবের কাছে। আর ফরাসিরা থেমেছিল তিউনিসিয়ায়। কিন্তু এরপর থেকে দুদলই একেবারে অপ্রতিরোধ্য। পরের তিন ম্যাচে আর কেউ থামাতে পারেনি দুদলকে। সব বাধা পেরিয়ে এখন দুদল ফাইনালে। রোড টু ফাইনালের সব শেষ ম্যাচে আর্জেন্টিনা উড়িয়ে দিয়েছে গত আসরের রানার আপ ক্রোয়েশিয়াকে।
আর ফরাসিরা বিধ্বস্ত করেছে এবারের বিশ্বকাপের সবচাইতে বড় চমক আফ্রিকার দেশ মরক্কোকে। দুদলই এখন ফাইনালে। যেখানে দুদলেরই লক্ষ্য নিজেদের শিরোপা সংখ্যাটাকে তিনে নিয়ে যাওয়া। আর সেখানে অবশ্য তৃঞ্চাটা আর্জেন্টিনারই একটু বেশি। কারণ তারা যে বিশ্বকাপের শিরোপা স্বাদ পাওয়াটা এক রকম ভুলেই গেছে।
২০১৪ সালে বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলার পর ২০১৫, ২০১৬ এবং ২০২১ সালে কোপা আমেরিকা কাপের ফাইনালে খেলে। দীর্ঘ ২৮ বছর পর ২০২১ সালে কোপা আমেরিকা কাপ জিতে কোনো আন্তর্জাতিক ট্রফি জয়ের অপূর্ণতা ঘুচায় আর্জেন্টিনা।
আর এ বছরের শুরুতে লাতিন আমেরিকা এবং ইউরোপের সেরা দুই দলের লড়াইয়ে ইতালিকে হারিয়ে ফিনালিসিমা জিতে নেয় মেসির দল। এবার শেষটা রাঙানোর পালা বিশ্বকাপ জিতে। গত বিশ্বকাপে এই ফ্রান্সের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছিল আর্জেন্টিনা নক আউট পর্বে। সে ম্যাচে আর্জেন্টিনার স্বপ্ন ভঙ্গ করেছিল কিলিয়ান এমবাপ্পে। আজকের ম্যাচেও দলে আছেন তিনি। শুধু যে আছেন তা কিন্তু নয়। একেবারে উড়ন্ত অবস্থায় আছেন এ বিশ্বকাপেও। পাঁচটি করে গোল করে মেসির সাথে যৌথভাবে আছেন গোলদাতার শীর্ষে। তাই আজকেও যে এই দুই ক্লাব সতীর্থের লড়াইটা পরস্পরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সেটা বলাই বাহুল্য। বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদটা আগের আসরে পেয়েছেন এমবাপ্পে। কিন্তু এখনো পাননি মেসি। তাই আজ ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচ খেলতে নামা মেসি সবকিছু নিংড়ে দেবে সেটা নিশ্চিত। আর এমবাপ্পেও যে ছেড়ে দেবে না সেটাতো আরো পরিষ্কার।
বিশ্বকাপের আগের আসরের দুঃসহ স্মৃতিটা বাদ দিলে আর্জেন্টিনা ফ্রান্স লড়াইয়ে অনেক এগিয়ে আর্জেন্টিনা। দুদলের মোট ১২ লড়াইয়ে আর্জেন্টিনার জয় ৬টি। ফ্রান্সের জয় ৩টি। তিনটি ম্যাচ ড্র হয়েছে। বিশ্বকাপের তিন দেখায় আর্জেন্টিনার জয় দুটি। ১৯৩০ সালে আর্জেন্টিনা জিতেছিল ১-০ গোলে। ১৯৭৮ সালে আলবিসেলেস্তাদের জয়টা ছিল ২-১ গোলের। আর ২০১৮ সালে ফরাসিরা জিতেছিল ৪-৩ গোলে। এই ১২ ম্যাচে আর্জেন্টিনা গোল দিয়েছে ১৫টি আর ফ্রান্স দিয়েছে ১১টি। আর্জেন্টিনা যেখানে ষষ্ঠবারের বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলছে সেখানে ফ্রান্স খেলছে চতুর্থবারের মত। তবে দুদলই শিরোপা জিতেছে ২টি করে।
এবারের বিশ্বকাপে যে দলটা ফেভারিটের তকমা নিয়ে এসেও হার দিয়ে শুরু করেছিল, সে আর্জেন্টিনাকে নিয়ে অনেকেই সন্দিহান হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে অপ্রতিরোধ্য এক দলে পরিণত হয়েছে। মেসিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে আর্জেন্টিনার স্বপ্ন। আর একজন মেসির জন্য এবারের বিশ্বকাপটা জিততে মরিয়া আর্জেন্টিনার ফুটবলাররা। কারণ এই মেসিই যে দলটির প্রাণভোমরা। বিশ্ব ফুটবলের প্রায় সবধরনের ট্রফি উঠেছে তার হাতে। বাকি শুধু একটাই। আর সেটা হচ্ছে বিশ্বকাপ। পেলে, ম্যারাডোনা, রোনালদো, রোমারিওদের মত ফুটবলাররা বিশ্বকাপ জিতে অমরত্ব লাভ করেছেন।
কিন্তু মেসি এখনো সেই স্বপ্ন দুয়ারের তালা ভাঙতে পারেননি। আজ সেটা ভাঙার পালা। ক্যারিয়ারের শেষটা বর্ণিল আলোকচ্ছটায় রাঙিয়ে দিতে মেসির যে এটাই শেষ সুযোগ। একই সাথে ডি পল, আলভারেস, মার্টিনেজ, ডি মারিয়া, রোমেরো, ওটামন্ডি, মলিনারা যেন মেসির জন্য বিশ্বকাপটা জেতাটাকে নিজেদের কর্তব্য হিসেবে নিয়ে রেখেছে। এমন তাগিদ যে দলের ভেতর তাদের বিশ্বকাপ না জেতাটাই যেন একটা অপরাধ। তেমন অপরাধে নিশ্চয়ই পা দিতে চাইবে না আলবিসেলেস্তারা। অপরদিকে ফ্রান্স বিশ্বকাপ শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখে পরপর দুটি বিশ্বকাপ জেতা দল হিসেবে ইতালি এবং ব্রাজিলের সমকক্ষ হতে চাইবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালটা হবে একটি বারুদ লড়াই। লড়াইয়ের মঞ্চ কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামও যেন প্রস্তুত নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে বরণ করে নিতে।