সিটি কর্পোরেশন ভাবনায় যশোরবাসী
মালিক উজ জামান, যশোর : ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী যশোরে জনসভায় এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন শহরের ঈদগাহ মাঠে জেলা আওয়ামী লীগের জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেছিলেন পরবর্তীতে ক্ষমতায় এলে যশোর পৌরসভাকে সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত করবেন। এরপর শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছেন। টানা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন সেই ২০১২ থেকে ধরলেও ১০ বছর। কিন্তু যশোর পৌরসভাকে সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দীর্ঘ প্রতীক্ষায় রয়েছেন যশোরবাসী। কিন্তু কবে সেই প্রতীক্ষার অবসান হবে সেটা এখনো অনিশ্চিত।
জানা যায়, বিদ্যমান স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন-২০০৯ এর স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) প্রতিষ্ঠা বিধিমালা ২০১০ অনুযায়ী যে কোনো সিটি কর্পোরেশন গঠনের জন্য ৮ শর্ত পূরণের বাধ্যবাধকতা থাকে। যশোর সিটি কর্পোরেশন গঠনের ক্ষেত্রে আয়তন ও জনসংখ্যা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ সিটি কর্পোরেশন হতে হলে শহরের আয়তন কমপক্ষে ২৫ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা কমপক্ষে চার লাখ হতে হবে। এখন আয়তন ২২ কি:মি: জনসংখ্যা চারলাখের বেশি। তবে এখানে একটি শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। কেননা অনেকেই যশোর পৌরসভায় বাড়ি ঘর করলেও এখানে ভোটা হননি। সরেজমিনে দেখা গেছে পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডে রেলগেট পশ্চিমপাড়ায় দেড় শতাধিক সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবার বসবাস করেন। এরা মাত্র ৫/৬টি পরিবার ভোটার হয়েছেন। এমনি ফাঁকি রয়েছে পৌরসভার সর্বত্র সকল মহল্লায়। এসব কারনে লোকসংখ্যা কাগজে কলমে কম। নইলে এখানে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করেন বলে নাগরিক অভিমত যথেষ্ট।
২০১৯ সালে ২৪ আগস্ট যশোর পৌরসভার সীমানা বাড়িয়ে প্রথম গেজেট প্রকাশ হয়। স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন ২০০৯ অনুযায়ী স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এ গেজেট প্রকাশ করে। এ বিষয়ে কোনো আপত্তি থাকলে সংশ্লিষ্ট ইউপির চেয়ারম্যানদের লিখিতভাবে জানানো ও শুনানিতে অংশ নেয়। এসব প্রক্রিয়া শেষে যশোরের ডিসি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ আকারে পাঠান। আর সেই সুপারিশের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় যশোর পৌরসভার সীমানা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে গেজেট প্রকাশ করেছে। ১৮৬৪ সালে যশোর পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই অর্থে যশোর শহর দেড়শ বছরের বেশি প্রাচীন। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানেও কখনো যশোর পৌরসভার আয়তন বাড়েনি। এই প্রথম সীমানা বাড়িয়ে বিস্তৃত হচ্ছে পৌর শহরের আয়তন। যশোর পৌর এলাকার বর্তমান আয়তন সাড়ে ১৪ বর্গ কিলোমিটারের একটু বেশি। তবে এবার বেড়েছে এর আয়তন। শহর সংলগ্ন ৬টি ইউপির ৭ বর্গ কিলোমিটারের কিছু বেশি অংশ পৌর এলাকায় যুক্ত হয়েছে।
যশোর পৌরসভা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, আয়তনে তুলনামূলক ছোট হওয়ায় উন্নয়ন কাজে অনেক দাতা সংস্থা এখানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয় না। মূলত পৌরসভার আয়তনের উপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ আসে। বর্তমানে এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে এই পৌরসভার শত কোটি টাকার উপরে উন্নয়ন কাজ চলছে। পৌরসভার আয়তন বাড়লে এই বরাদ্দ আরো বেশি হতো বলে সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে। পৌরসভার আয়তন বৃদ্ধির এই বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে উন্নয়ন কাজে আরো নতুন নতুন বরাদ্দ আসবে।
যশোর পৌরসভার সচিব জানান, সীমানা বাড়ানোর গেজেট হয়েছে। পৌরসভার সীমানা ১৪ দশমিক ৭২ কিলোমিটারের সঙ্গে ৭ কিলোমিটারের কিছু বেশি বেড়ে এখন প্রায় ২২ কিলোমিটার। নির্বাচনে খসড়া ভোটার তালিকা অনুযায়ী, ২০২১ সালে যশোর পৌরসভায় ভোটার ১,৪৬,৫৯৮ জন। এরমধ্যে পুরুষ ৭২০৫৫ এবং মহিলা ভোটার রয়েছে ৭৪৫৪৩ জন। তবে এছাড়া ভোটার নয় এমন মানুষ রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমানে।
স্থানীয় সরকার যশোরের উপ-পরিচালক মো. হুসাইন শওকত বলেন, সিটি কর্পোরেশনের অন্যতম শর্ত আয়তন ও লোকসংখ্যা। এ দুটো শর্ত পূরণ না হলে সিটি কর্পোরেশন করা কঠিন। তবে সিটি কর্পোরেশনে উন্নীতকরণে তার দপ্তরে কোন আপডেট নেই। অফিসিয়ালি কোন প্রস্তাব পাঠানো হয়নি। কিংবা মন্ত্রণালয় থেকে কোন চিঠি আসেনি। পৌরসভার সীমানা বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। সর্বশেষ যেসব এলাকা থেকে আপত্তি তুলে আবেদন করা হয়েছিল। সেগুলোর নিষ্পত্তি করে গেজেট প্রকাশের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে যশোর সিটি কর্পোরেশন দাবিতে প্রায় এক দশক ধরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও উন্নয়ন ফোরাম এ দাবিতে মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে মতবিনিময় করে চলেছে। সংসদেও এ দাবিতে কথা বলেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। কিন্তু বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি নেই। ফলে দিনে দিনে জেলাবাসীর হতাশা বেড়ে চলেছে।
ঢাকাস্থ বৃহত্তর যশোর উন্নয়ন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সৈয়দ ইকবাল হাসান মিডিয়াকে জানান, তারা বৃহত্তর যশোর, নড়াইল, ঝিনাইদহ ও মাগুরার উন্নয়ন নিয়ে বিভিন্ন সভা সেমিনারে কথা বলছেন। তারা যশোরের সিটি কর্পোরেশনসহ ১১ দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করেছেন। এ দাবিতে তারা একটি সাব কমিটি গঠন করেছেন। মঙ্গলবার তাদের পরিষদের মিটিং হয়েছে। সেখানেও আলোচনা হয়েছে। যশোরের গর্ভে খুলনার জন্ম। কিন্তু সেই খুলনা বিভাগ ও সিটি কর্পোরেশন হয়েছে। বঞ্চিত হয়েছে যশোর। যে কারণেই হোক যশোরকে সেভাবে প্রসার করা যায়নি। তুলে ধরা হয়নি। এজন্য আজ দাবি আদায়ে মাঠে নামতে হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, উন্নয়নে ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের অভাব। শহীদ মশিউর রহমানের সেই নেতৃত্ব ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত হওয়ায় যশোরে সেই নেতৃত্বের শূণ্যতা সৃষ্টি হয়। এজন্য স্বাধীনতার পর যশোর অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এখন অনেক সংসদ সদস্য বৃহত্তর যশোরের উন্নয়নে কথা বলছেন ঠিকই। কিন্তু চাওয়ার মতো চাইতে হবে। ছিলেন জাতীয় রাজনৈতিক নেতা আওয়ামীলীগের খান টিপু সুলতান, বিএনপির তরিকুল ইসলাম কিন্ত কোন ফায়দা আসেনি। এখন কাজী নাবিল আহম্দে এমপি হিসাবে যশোরের পক্ষে সাফাই গাইছেন, তবে আরো জোরালো হতে হবে আবেদন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত যশোর সিটি কর্পোরেশন বাস্তবায়ন দাবিতে জনগণে সোচ্চার যশোর-৩ সদর আসনের এমপি কাজী নাবিল আহমেদ। বিভিন্ন ফোরামে তিনি সিটি কর্পোরশেন দাবি তুলেছেন। ২০১৯ সালের ৫ মার্চ রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় সংসদে যশোর সিটি কর্পোরেশন দাবি জানান এমপি কাজী নাবিল আহমেদ। এসময় তিনি যশোরকে বিভাগ করা দাবিও জানান। চলতি বছরের ২০ জুন জাতীয় সংসদের ১৮তম ও ২০২২ সালের বাজেট অধিবেশনে বিষয়ভিত্তিক বক্তৃতায় তিনি যশোরকে অবিলম্বে বিভাগ ও পৌরসভাকে সিটি কর্পোরেশন করার দাবি করেন। কিন্তু দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি নেই এই বিষয়ে।
এবিষয়ে নাগরিক অধিকার আন্দোলন যশোরের সভাপতি মাস্টার নূর জালাল জানান, আমাদের অন্যতম প্রধান দাবি যশোর সিটি কর্পোরেশন হোক। যাদের ক্ষমতা আছে তারা এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেন। আমরা দাবি জানিয়ে যাব। যদি কেউ দাবি আদায়ে পথে নামেন তাদের সাথে আমরাও পথে নামতে রাজি।