এনবিআর চেয়ারম্যান কি নিজেকে সম্রাট ভাবেন, প্রশ্ন হাইকোর্টের
ই-অরেঞ্জের লেনদেনের বিপরীতে রাজস্ব আদায়ের তথ্য চেয়ে না পাওয়ায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের ভূমিকা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে আদালত বলেছেন, ‘উনি নিজেকে কি সম্রাট ভাবেন?’
রবিবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষকে উদ্দেশ্য করে একথা বলেন।
ই-অরেঞ্জের পৃষ্ঠপোষক ও বরখাস্ত পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ এবং ই-অরেঞ্জের লেনদেনের বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে কিনা, তা জানাতে স্বরাষ্ট্র সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যানকে গত ২৯ জানুয়ারি দুই সপ্তাহ সময় দেন আদালত। স্বরাষ্ট্র সচিব প্রতিবেদন দিলেও এনবিআর চেয়ারম্যান কোনো প্রতিবেদন দেননি।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী আব্দুল কাইয়ুম লিটন। বিএফআইইউ’র পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শামীম খালেদ আহমেদ। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একে এম আমিন উদ্দিন মানিক।
শুনানিতে ই-অরেঞ্জ প্রতারণার মামলার তদন্তের বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, ‘মামলার তদন্ত চলছে। গত বৃহস্পতিবার একেবারে শেষ বেলায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাগজপত্র হাতে এসেছে। যে কারণে হলফনামা করা হয়নি। আগামী সপ্তাহে দাখিল করা যাবে।’
সোহেল রানার অবস্থান জানিয়ে আইন কর্মকর্তা মানিক বলেন, ‘পত্রিকায় এসেছে, জামিন নিয়ে ভারতের কারাগার থেকে সোহেল রানা পালিয়ে গেছেন। ভারত থেকে তথ্য নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইজিপির প্রতিবেদন একই ধরনের।’
রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী এম আবদুল কাইয়ুম লিটন তখন বলেন, ‘আদেশ প্রতিপালনের জন্য সময় চাইলে আদালত সময় দিতে পারেন। এনবিআরের চেয়ারম্যান তো প্রতিবেদনই দাখিল করেননি। আর শেখ সোহেল রানার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারির জন্য ইন্টারপোল কিছু তথ্য চেয়েছিল। দেওয়া হয়নি বলে দেখা যাচ্ছে।’
এ পর্যায়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মানিক বলেন, ‘সোহেল রানার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড এলার্ট জারি হয়েছে, সেই নম্বরও আছে। হলফনামা করে দাখিল করা হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রিপোর্ট পাইনি।’
আদালতের সর্বশেষ আদেশ এনবিআর চেয়ারম্যানকে জানানো হয়েছিল কিনা, রাষ্ট্রপক্ষের কাছে জানতে চাইলে আইন কর্মকর্তা মানিক বলেন, ‘জানিয়েছি। বারবার অনুরোধ করার পরও গুরুত্ব দিচ্ছে না।’
তখন আদালত বলেন, ‘উনি (এনবিআর চেয়ারম্যান) কেন আদালতের আদেশ মানছেন না? উনি নিজেকে কি সম্রাট ভাবছেন? যে তথ্য চাওয়া হয়েছে তা এনবিআরের চেয়ারম্যানকে দাখিল করতে বলবেন।’
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক আদালতের নির্দেশ জানাবেন বলে জানালে আদালত বলেন, ‘আমরা শেষ সুযোগ দিচ্ছি। এবার প্রতিবেদন না পেলে ডাকা হবে।’
এরপর আদালত ২৭ মার্চ পরবর্তী শুনানি ও আদেশের তারিখ রাখেন।
ই-অরেঞ্জ থেকে ৭৭ কোটি টাকার পণ্য কিনে প্রতারণার শিকার ৫৪৭ জন গ্রাহকের পক্ষে মো. আফজাল হোসেন, মো. আরাফাত আলী, মো. তরিকুল আলম, সাকিবুল ইসলাম, রানা খান ও মো. হাবিবুল্লাহ জাহিদ নামের ছয়জন গ্রাহক গত বছর মার্চে হাইকোর্টে রিট করেন।
ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার ভাই সোহেল রানা, বিথি আক্তারসহ ই-অরেঞ্জের সঙ্গে সম্পৃক্তদের ব্যাংকসহ কার কোথায় কত ব্যক্তিগত সম্পদ আছে তা তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশন -দুদক ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)’র দক্ষ কর্মকর্তাদের দিয়ে কমিটি গঠনের নির্দেশনাসহ রুল চাওয়া হয় রিটে।
সে রিটের প্রাথমিক শুনানির পর ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে গ্রাহক ঠকানো, টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। দুদক, বিএফআইইউ ও সিআইডকে চার মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
সেই সঙ্গে গ্রাহক নিরাপত্তা, সুরক্ষায় ই-অরেঞ্জের সঙ্গে সম্পৃক্ত বনানী থানার সাময়িক বরখাস্ত পরিদর্শক (তদন্ত) সোহেল রানা, সোনিয়া মেহজাবিন ও বিথি আক্তারসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বিবাদীদের ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, জানতে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
সোহেল রানা, সোনিয়া মেহজাবিন ও বিথি আক্তারসহ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার করে ক্ষতি অনুপাতে রিট আবেদনকারীসহ প্রতারিত অন্যান্য গ্রাহকদের মাঝে সে টাকা বণ্টন বা বিতরণের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়।
বাণিজ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, দুদক চেয়ারম্যান, পুলিশের মহাপরিদর্শক, বিএফআইউ‘র প্রধান, সোহেল রানা, সোনিয়া মেহজাবিন ও বিথি আক্তারকে রুলের জবাব দিতে বলেন আদালত। এ আদেশের পর বিএফআইইউ, দুদক ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) প্রতিবেদন দেয়, যা গত বছর ৩ নভেম্বর আদালতে উপস্থাপন করা হয়। সেদিন এ তিন সংস্থার প্রতিবেদন দেখে উষ্মা প্রকাশ করেন আদালত। আদালতের মন্তব্য ছিল প্রতিবেদনগুলো ‘খাপছাড়া’, ‘পাশ কাটানো।’
এরপর আদালত স্বরাষ্ট্র সচিবকে নির্দেশ দেন, সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে। আর ই-অরেঞ্জের কার্যক্রম চালানোর সময় লেনদেনের বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে কিনা, তা জানাতে বলা হয় চেয়ারম্যানকে। সেই সঙ্গে ই-অরেঞ্জ সংশ্লিষ্ট অভিযোগ স্পষ্ট করে ৩০ দিনের মধ্যে ফের প্রতিবেদন দিতে বলা হয় বিবাদীদের। এ আদেশের পর নির্ধারিত তারিখে প্রতিবেদন না দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ দুই সপ্তাহ সময় নেয়। সে ধারাবাহিকতায় গত ২৯ জানুয়ারি শুনানিতে উঠলে ফের সময় চাওয়া হয়। সেদিন আদালত দুই সপ্তাহ সময় দিয়ে ১৯ ফেব্রুয়ারি তারিখ রেখেছিলেন।