অর্থ ও বাণিজ্যআঞ্চলিক

জগদীশপুর তুলা খামারে জনবল সঙ্কট সমস্যা প্রকট


মালিক উজ জামান, যশোর : ঐতিহ্যবাহী দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ তুলা গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও বীজবর্ধন খামারটি যশোরের চৌগাছা উপজেলার জগদীশপুরে অবস্থিত। চলতি মৌসুমে বিভিন্ন জাত ও উন্নত মানের তুলা চাষ হয়েছে। খামারের প্রতি তুলা গাছে ফুটে আছে সাদা তুলা। কর্তৃপক্ষ গাছ থেকে তুলা সংগ্রহ এবং সংরক্ষণে এখন ব্যস্ত। তবে জনবল সঙ্কটে বৃহৎ এই খামারের স্বাভাবিক কাজ তীব্র আকারে ব্যহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
১৫০ একর জমিতে তুলা গবেষণা ও বীজবর্ধন খামার অবস্থিত। ৫৫ একর জমিতে চলতি মৌসুমে তুলা চাষ হয়। কিছু অংশে চাষ হয়েছিল ছন, পাট। বাকি জমি পড়ে ছিল। প্রতিষ্ঠালগ্নে খামার নিরাপত্তায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা হয়। সেটি নষ্ট হয়ে বছরের পর বছর খামারটি অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এরপর কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। সম্প্রতি ৩ কোটি ৫ লাখ টাকা ব্যয়ে খামারের ১০৭৬৪ ফুট এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে প্রাচীর। কিন্তু যে উদ্যেশ্যে খামার প্রতিষ্ঠা সেই লক্ষ পূরণ হয়নি। তুলা চাষিদের আগের মত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। তুলাচাষ হ্রাস পেয়েছে। চাষ কাজে ব্যবহৃত অধিকাংশ যানসহ যন্ত্রপাতি বিকল।
একমাত্র তুলা গবেষণা কেন্দ্র ও বীজবর্ধন খামারটি ব্যাপক জনবল সঙ্কটে পতিত। ফলে এর সকল কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। খামারের ২৭ পদের মধ্যে ১৭ পদ শূন্য। কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে বারবার জানানো হলেও শূন্যপদ পূরণ হয়নি। এই অবস্থায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনে সংশ্লিষ্টদের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ এলাকার তুলা চাষীরা।
১৯৮০ সালে জগদীশপুর গ্রামে প্রায় ৫০০ বিঘা জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে তুলা গবেষণা ও বীজবর্ধন খামার প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠার ফলে তুলা উৎপাদন, গবেষণা কার্যক্রম ও তুলা চাষীদের প্রশিক্ষণ ছিল চোখে পড়ার মত। স্থানীয় তুলা চাষীদের সাথে খামার কর্তৃপক্ষের তৈরি হয় সুসম্পর্ক। কিন্তু ধীরে ধীরে তুলা চাষের কার্যক্রম স্থিমিত হয়ে পড়ে। স্থানীয় কৃষকরা এখন আগের মতো তুলা চাষ করে না। কৃষকরা জানিয়েছেন, খামারে জনবল সংকট তীব্র। এছাড়া পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে লাখ লাখ টাকার কৃষি যন্ত্রপাতি। বর্তমানে উর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার পদ খালি। ২ জন এসও কর্মকর্তা স্থলে আছে ১ জন। ল্যাব এ্যাসিসট্যান্ট ২টি পদ খালি। এ ছাড়া মাঠ সহকারী ৪ জন, কম্পিউটার অপারেটর ১, উচ্চমান সহকারী ১, ক্যাশিয়ার ১টি পদ খালি।
খামারের এমএলএসএস পদ ও দারোয়ান পদ শূন্য ছিল। এছাড়া বর্তমানে যারা কর্মরত তাদের মধ্য হতে দুই জন ২০২১ সালের মার্চ মাসে অবসরে গেছেন। তাদের অবসরের পর মাত্র ৮ জন কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়ে কিভাবে খামারটি পরিচালিত হবে তা নিয়ে ছিল উদ্বেগ ও হতাশা। খালি পদ গুলোতে জনবল নিয়োগ হলে খামারটির কার্যক্রমে গতি ফিরে আসবে বলে জানান স্থানীয় তুলা চাষীরা।
খামার ব্যবস্থাপক জানান, জনবল সংকটের মধ্যে সব কাজ করতে হচ্ছে। জনবল সংকটের সমস্যা তুলে ধরে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। কিন্তু সন্তোষজনক কিছু হয়নি। তবে আশা হয় দ্রুত সময়ে শুন্য পদে লোক নিয়োগ হবে। সচেতন মহলের দাবি রাস্তা সংস্কার ও জনবল সংকট কাটালে খামারটি আগের অবস্থায় ফিরতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ তুলা গবেষণা ও বীজবর্ধন খামার হওয়া সত্ত্বেও নেই পর্যাপ্ত জনবল। বড় সংকট অর্থ। খামারটিতে ২৫ জন অভিজ্ঞ কর্মকর্তা আবশ্যক। সেখানে মাত্র ১২ জন কর্মরত আছেন। সংশি¬ষ্ট মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার অবহিত করা হলেও শূন্য পদ আজও পূরণ হয়নি। তুলা চাষ ও গবেষণায় প্রচুর অর্থ প্রয়োজন। বিশেষ করে গবেষণায় যে পরিমাণ অর্থ ছাড় হওয়ার কথা সেটি হয় না। যে কারণে গবেষণা চরম ব্যাহত হচ্ছে। খামার কর্তৃপক্ষসহ এলাকাবাসী ঐহিত্যবাহী এই তুলা গবেষণা ও বীজবর্ধন খামার যে লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা যেন অব্যাহত থাকে সে জন্য সংশি¬ষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
তুলা গবেষনা ও বীজবর্ধন খামারের কটোন এগ্রোনোমিস্ট জুবায়ের ইসলাম তালুকদার জানান, নানা প্রতিকুলতার মধ্যে ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠান সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গত মৌসুমে খামার হতে ৬০ টন তুলা উৎপাদন হয়। এবছর কিছুটা কমে ৫২/৫৩ টন তুলা উৎপাদন হবে আশা করা হচ্ছে। আবহাওয়া জনিত কারণে উৎপাদন কিছু কম হবে। তিনি আরো জানান, চলতি মৌসুমে ৪৭ হেক্টর জমিতে তুলা চাষ করা হয়েছে। সিডি-১২, ১৪, ১৫, ১৬, হাইব্রিড-১ সহ বেশ কিছু উন্নত জাতের তুলা চাষ হয়েছে যা এই খামারের গবেষনার ফল।
এছাড়া দেশের বেশ কিছু খামার হতে উন্নত জাতের তুলা বীজ সংগ্রহের পাশাপাশি দেশের বাইরে বিদেশ হতে বিশেষ করে চীন ও তুরস্ক হতে বীজ সংগ্রহ করে এই খামারে উৎপাদিত জাতের সাথে ক্রস করে উন্নত জাত তৈরি করা হয়েছে। এই জাত হতে ভালো ফলন আশা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে তার পরীক্ষা নিরীক্ষা পর্ব সম্পন্ন হয়েছে। খামার অভ্যন্তরে সড়কের চরম হাল ছিল। সম্প্রতি বেশ কিছু সড়ক নির্মাণ হয়েছে, একটি অত্যাধুনিক গোডাউন নির্মিত হচ্ছে যা খামারের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। তবে জনবল সংকট সব থেকে বড় সংকট যা স্বাভাবিক কাজকে ব্যহত করছে মারাত্মকভাবে। দ্রুত শুন্যপদ গুলো পূরণ হলে খামারের কার্যক্রমে আরও গতি ফিরে আসবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
তুলা গবেষনা, প্রশিক্ষণ ও বীজ বর্ধন খামার জগদীশপুর। চৌগাছা তথা বৃহত্তর যশোর জেলার অন্যতম গৌরবজ্জ্বল প্রতিষ্ঠান। এটি ১৯৮০ সালে জগদীশপুরের কৃতি সন্তান এম মনির-উজ-জামান (সাবেক সচিব) এর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম)। খামারটি বাংলাদেশ সরকার এবং ই, ই, সি (ইইউ) এর আর্থিক সহায়কায় প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের আবাদকৃত তুলা উৎপাদিত জমির প্রায় তিন চতুর্থাংশ বৃহত্তর যশোর ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্গত। অত্র এলাকায় আবহাওয়া উপযোগী তুলার উচ্চ ফলনশীল জাত, উদ্ভাবন, তুলা খামারের কৃষি তাত্ত্বিক পোকামাকড় দমন। রোগ বালাই নিয়ন্ত্রণ ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনের জন্য লাগসই গবেষনা কার্যক্রম পরিচালনা এবং তুলা চাষীদের চাহিদা মোতাবেক উন্নত মানের তুলা বীজ সরবরাহ নিশ্চিত করণসহ তুলাচাষী ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে তুলা চাষে দক্ষ করে গড়ে তুলতে খামারটি প্রতিষ্ঠা।
প্রশিক্ষণ কর্মে দক্ষতা বৃদ্ধিতে অতীব জরুরী। তাই মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণের জন্য ডরমেটরী ব্যবস্থা আছে যেখানে ১২০ জনের থাকা খাওয়া ও প্রশিক্ষন দেওয়া যায়। ৪ দিন করে বছরে ২বার বৃহত্তর যশোর, ঝিনাইদাহ, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া থেকে আগত কৃষক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তুলা উন্নয়ন বোর্ডের জোনাল কার্যালয় থেকে ঋন ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া ষ্টাফ ট্রেনিং ব্যবস্থা আছে।
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এম এম আবেদ আলী জানান ‘বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (ব্রিডিং) ৫টি ডিসিপ্লিন এর গবেষনামূলক কাজ পরিচালনায় ২০/২৫ জন বিজ্ঞানীর কাজের সুযোগ আছে। কিন্তু সে স্থানে ৫টা ডিসিপ্লিন এর উপর মাত্র ১জন বিজ্ঞানী। প্রতিটি ক্ষেত্রে জনবল খুব অল্প। অন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতো জনবল হলে এবং কাজ করার সুযোগ দিলে খামারটি আরো সম্প্রসারিত হবে। কাজের গতি বাড়বে ও গবেষনার উৎকর্ষ সাধিত হবে।
তুলা গবেষনায় বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের নব উদ্ভাবন
‘তুলা গবেষণা জগদীশপুর খামার থেকে তুলার উন্নত জাত সি,বি-৫ উদ্ভাবিত হয়েছে। যা উচ্চ ফলশীল জাত, এর আশের শতকরা হার বেশী, তুলনামূলক পোকার আক্রমণ কম। অত্র গবেষণা কেন্দ্রে বিজ্ঞানী ও মাঠ কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ১টি হাইব্রীড তুলা জাত চুড়ান্ত পর্যায়ে। আরো জাত প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া তুলায় সারের প্রয়োগমাত্রা উদ্ভাবিত হয়েছে। চাষীদের চাহিদা মোতাবেক তুলার উন্নত জাত উদ্ভাবন সহ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে জরুরী ভিত্তিতে ডিসিপ্লিন ওয়ারী গবেষক নিয়োগ জরুরি। মাঠ ও অফিস ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি পূরনে জনবল নিয়োগ করা একান্ত প্রয়োজন। তবে হাইব্রীড জাতের তুলা উৎপাদনের যে প্রচেষ্টা তা ভবিষ্যতে সফল হবে বলা যায়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button