বিশেষ খবর

তোরা ভাত খাইতে পাস না, আবার দামি মোবাইল পাইলি কেমনে?

 

তোরা ভাত খাইতে পাস না, আবার দামি মোবাইল পাইলি কেমনে?’ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন মেয়র সেলিনা হায়াত আইভীর এরকম মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ ৬ দফা দাবি আদায়ে ময়লা ফেলে নারায়ণগঞ্জ নগর ভবন ঘেরাও করেছে শত শত পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তারা নাসিকের কর্মকর্তাসহ মেয়র সেলিনা হায়াত আইভীকে অবরুদ্ধ করে রাখে। ওই সময় মেয়র আইভী পরিচ্ছন্নকর্মীসহ দায়িত্বরতদের চাকরি থাকবে না বলেও হুমকি দেন। এ ঘটনার  পর থেকেই মেয়র আইভী ও আনদোলনরত পরিচ্ছন্নকর্মীদের কথপোকথনের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।

মঙ্গলবার বিকাল ৪টায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নগরভবনে এ ঘটনা ঘটে। এর আগে, বেলা ১১টা থেকে প্রায় ৫ শতাধিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী নগর ভবন ঘেরাও করে। তারা বাড়িঘরের ময়লা-আবর্জনা নগর ভবনের বাইরের উঠানে ফেলে রাখেন। এছাড়া নগর ভবনে রাখা নাসিকের কর্মকর্তাদের গাড়িতেও ময়লা নিক্ষেপ করেন বিক্ষুব্ধরা।

ঘটনার এক পর্যায়ে পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা নগর ভবনের উঠানে ও গাড়িতে ময়লা ফেলে বিক্ষোভ করায় উত্তেজিত হয়ে মেয়র আইভী নগর ভবন থেকে বের হয়ে আসেন এবং আন্দোলনরত পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ওপর ক্ষোভ ঝাড়েন। এসময় উপস্থিত বিক্ষোভকারীরাসহ গণমাধ্যমকর্মীরা তা ভিডিও করতে থাকেন। এতে মেয়র আইভী আন্দোলনরত পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের চাকরিচ্যুত করার হুমকি দিয়ে বলেন, তোরা ভাত খাইতে পাস না, আবার দামি মোবাইল পাইলি কেমনে? তোমরা অস্থায়ী, বাংলাদেশ সরকার তোমাদের চাকরি স্থায়ী করে নাই। আমার মন চাইলে তোমাদের রাখতে পারি, মন না চাইলে রাখমু না। তোমাদের এখানে ময়লা ফেলার দুঃসাহস কে দিল?

এ সময় স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মী তৌকির রাসেল মোবাইলে ভিডিও ধারণ করার সময় মেয়র আইভী তাকেও তুই-তোকারি করেন। রাসেল পরিচয়  দিয়ে  বলেন, আমি সাংবাদিক। এদিকে, এমন পরিস্থিতিতে নগর ভবনে পরিচ্ছন্নকর্মীদের সঙ্গে দেখা করে কথা বলার সময় গণমাধ্যমকর্মীরা ছবি তুলতে গেলে সেখানেও ক্ষুব্ধ হয়ে যান মেয়র আইভী। সাংবাদিকদের তিনি প্রশ্ন করেন, এখানে এমন কী হয়েছে যে আসতে হবে? পরে পরিচ্ছন্নকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি উত্তেজিত হয়ে আন্দোলনকারীদের ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি শিমুল দাস ও সাধারণ সম্পাদক কিশোর লালকে চাকরি থেকে বহিষ্কারের হুমকি দেন। আইভীর এমন কথপোকথনে পরিস্থিতি আরও বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। একপর্যায়ে সেখান থেকে দৌড়ে কার্যালয়ে অভ্যন্তরে পালিয়ে রক্ষা পান কনজারভেন্সি সুপার ভাইজার শ্যামল চন্দ্র পাল ও মেয়রের ব্যক্তিগত সহকারী আবুল হোসেন।

আন্দোলনরত পরিচ্ছন্নকর্মীদের নেতৃত্ব দেয়া শ্রমিক নেতা হাফিজ জানান, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সদর, বন্দর ও সিদ্ধিরগঞ্জ অঞ্চলে মোট ১ হাজার ২শ পরিচ্ছন্নতাকর্মী কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। এক বছর আগেই সিটি করপোরেশন এই পরিচ্ছন্নকর্মীদের তাদের আধুনিক বাসস্থানের আশ্বাস দিয়ে তাদের আদি বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করে; কিন্তু এই এক হাজার ২শ পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের মধ্যে মাত্র দেড়শ থেকে ২শর মতো কর্মীদের তারা নতুন বাসস্থানে স্থানান্তর করেছেন। যাদের সেখানে নেওয়া হয়েছে তাদের কাছ থেকে ঘরভাড়া বাবদ পাঁচ হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে; কিন্তু বর্ধিত বেতন পাননি কেউই।

শহরের পরিচ্ছন্নতা কর্মী রানী দাস জানান, বাংলাদেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশনে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা তাদের পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিবাসে থাকেন। কোথাও এভাবে ফ্ল্যাটে থাকার জন্য ভাড়া দিতে হয় না; কিন্তু মেয়র আইভী আমাদের বলে এই ভবনগুলো সরকারি টাকা দিয়ে নির্মাণ করা হয়নি, বিদেশ থেকে ফান্ড এনে এই ভবনগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। তাই আমাদের মাসে পাঁচ হাজার করে ভাড়া দিতে হবে। আমরা সারা মাস কাজ করে বেতন পাই তিন হাজার ৮০০ টাকা থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা। যদিও তিন মাস আগে আট হাজার টাকা বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে, তবে এই বেতন এখনো কার্যকর করা হয়নি। আর কার্যকর হলেও যদি বাসা ভাড়া ৫ হাজার, বিদ্যুৎ-গ্যাস বিল এক হাজার করে দিতে হয়- তবে বাকি ২ হাজার টাকায় সংসার চালাব কী করে? এর মধ্যে পূজা বাবদ অগ্রিম প্রদত্ত টাকা থেকে প্রতি মাসে এক হাজার টাকা কেটে নেওয়া হয়।

বাসন্তি দাস নামের আরেক কর্মী জানান, আমাদের আবাসনের ব্যবস্থা না করেই আমাদের বাপ-দাদার বাসস্থান ভেঙে দেওয়া হয়েছে। যেখানে আমাদের যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেবেন মেয়র, সেখানে আমাদের দাবি-দাওয়ার তোয়াক্বা না করে উল্টো আমাদের চাকরিচ্যুত করার হুমকি দিয়েছেন।

আন্দোলন নিয়ে ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কিশোর লাল  জানান, যেখানে প্রধানমন্ত্রী পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করছেন, ভাড়া বাবদ কোনো টাকা কর্তন করতে নিষেধ করেছেন, সেখানে আমাদের মেয়র বাসা ভাড়া বাবদ ৫ হাজার টাকা কেটে নিচ্ছেন। তিনি বেতন বাড়িয়েছেন শুনেছি কিন্তু অফিসিয়ালি কোনো চিঠি আমরা পাইনি এবং সেই টাকাও পাইনি। এখন তিনি বলছেন ফান্ডে টাকা নাই। অথচ সিটি করপোরেশনের আয়ের অন্যতম উৎস হলো কনজারভেন্সি ট্যাক্স বা পরিচ্ছন্নতা কর, যা আমাদের কাজের মাধ্যমে আদায় হয়। এই জনগণের কর দিয়েই আমাদের বেতন দেওয়া সম্ভব কিন্তু এই টাকা অন্য ফান্ডে খরচ করেন বলেই মেয়র আইভী এখন বলেন ফান্ডে টাকা নেই। তিনি বলেন, আমাদের দাবি না মানলে আমরা শিগগিরই কর্মবিরতির ঘোষণা দেব।

এ সময় মেয়র আইভী বলেন, ‘গত তিন মাস আগে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের সচিব ও পরিচ্ছন্নকর্মীদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। তবে ফান্ডে টাকা না থাকায় তিন মাস ধরে কাউকেই বর্ধিত বেতন দেওয়া যাচ্ছে না।’ ঘটনাস্থলে থেকে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি আনিচুর রহমান বলেন, আসলে মেয়র আইভীকে অবরুদ্ধ করা হয়েছে বিষয়টি এমন না। পরিচ্ছন্নকর্মীরা বেতনভাতাসহ ৬ দফা দাবিতে নগর ভবনে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করছিলেন। তিনি নিজে নেমে এসে পরিচ্ছন্নকর্মীদের সাথে  কথা বলেন। তখন নানা কথপোকথন হয়। পরে পুলিশি নিরাপত্তায় মেয়র আইভী বিকালে নগর ভবন থেকে বের হন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button