মন্ত্রী-সচিব মুখ দেখাদেখি বন্ধ
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী ও সচিবের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। মন্ত্রণালয়ের কাজে মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার দিচ্ছেন এক ধরনের সিদ্ধান্ত, সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান দিচ্ছেন আরেক সিদ্ধান্ত। অনেক সময় মন্ত্রীকে না জানিয়ে সচিব একাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন এবং তা বাস্তবায়নও করার চেষ্টা করছেন। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে সচিবকে কারণ দর্শানোর ঘটনাও ঘটেছে। মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কাজেও দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। বিরূপ প্রভাব পড়ছে সংশ্লিষ্ট অধিদফতরগুলোতেও।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি উৎকণ্ঠা তৈরি করেছে প্রশাসনে। মন্ত্রী সব কিছু জানিয়েছেন জনপ্রশাসনে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী-সচিবের কাজে সমন্বয়হীনতার কোনো নজির নেই। মাননীয় মন্ত্রীর কোনো নির্দেশ অমান্য হয়েছে এ ধরনের কোনো নজিরও নেই। মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর সব কাজে সাচিবিক সহযোগিতা করার দায়িত্ব সচিবের। সেই কাজই আমি করছি।’ এ বিষয়ে মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, মন্ত্রীর সঙ্গে সচিবের বিরোধ নিয়ে শুধু ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় নয়, সচিবালয়েও তুমুল আলোচনা চলছে। অতীতে কোনো মন্ত্রণালয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। মন্ত্রীর সব বিষয়ে সচিবের বিরোধিতার কারণে জটিলতা বেড়েছে।
রুলস অব বিজনেসে মন্ত্রী ও সচিবের কাজের সীমারেখা চিহ্নিত করা আছে। তাদের এ সীমারেখা মানতেই হবে। এটা যদি কেউ না মানে তাহলে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন
মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের কর্র্মী পরিচয়দানকারী এ বি এম মাইনুল হোসেনের লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যায়, বিটিআরসি থেকে প্যাসিফিক বাংলাদেশ লিমিটেডের ২জি সেলুলার মোবাইল অপারেটরের লাইসেন্স বাতিলের পূর্বানুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারকে পুরোপুরি উপেক্ষা করেন সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান। ফাইলে মন্ত্রী পর্যায়ে নিষ্পত্তিযোগ্য উল্লেখ থাকার পরও সচিব নিজেই ফাইল অনুমোদনসহ স্বাক্ষর করে নিচে নামিয়ে দেন। তিন দিন পরে মন্ত্রী বিষয়টি জানতে পারলে সচিব কারিগরি ত্রুটির কথা বলেন। পরে গত ১৮ মার্চ মন্ত্রী ফাইলে নোট লেখেন, সচিব অতিরিক্ত সচিবের কাছে ফাইল পাঠিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কারিগরি ত্রুটির কোনো অজুহাত দিতে পারেন না। কেননা এখানে কোনো কারিগরি ত্রুটি ছিল না। সচিব ও অতিরিক্ত সচিব মন্ত্রীকে এড়িয়ে গিয়ে গর্হিত অপরাধ করেছেন। এ ভুলের কথা তিন দিনেও আমাকে অবহিত করা হয়নি। বরং আমি অন্যের কাছ থেকে খবর পেয়ে জানার চেষ্টা করার পর ১৬ মার্চ এই নথি উপস্থাপন করা হয়। সচিবালয় থেকে আর কোন কোন ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে তা নিরপেক্ষ তদন্তপূর্বক উপস্থাপন করা হোক।
একই সময়ে গত ১৭ মার্চ জাতীয় শিশু দিবস এবং ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে বিটিআরসিতে মোবাইল অপারেটর থেকে গ্রাহকদের মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি খুদে বার্তা পাঠানো নিয়ে বিরোধ তীব্র হয়। কারণ মন্ত্রীর সিদ্ধান্তে চিঠি দিয়ে বিটিআরসিকে জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে খুদে বার্তা পাঠাতে বলা হলেও তা পাঠানো হয়নি। বিষয়টি জানার পর মন্ত্রী বিটিআরসিকে শোকজ করতে বললে সচিব উল্টো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান। পরবর্তীতে মন্ত্রীর ফাইল নোটের কারণে বিটিআরসিকে শোকজ করতে বাধ্য হন।
জানা গেছে, সম্প্রতি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিষ্ঠান টেলিফোন শিল্প সংস্থা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ নিয়েও বিরোধ হয় মন্ত্রী ও সচিবের। মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সংসদীয় কমিটির সভাপতির পক্ষ থেকে দুই কর্মকর্তার নাম প্রস্তাব করা হলেও এ দুজনকে বাদ দিয়ে অন্য তিনজনের নাম প্রস্তাব করে ফাইল তৈরি করেন সচিব। মন্ত্রী তখন ফাইলে সচিবের প্রস্তাবিত তিনজনের বিষয়ে পুলিশ ভেরিফিকেশনের সিদ্ধান্ত দিয়ে দেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়, এতে মনোক্ষুণ্ন হয়ে মন্ত্রীর কাছে আর ফাইল না পাঠানোর সিদ্ধান্তের কথা অন্য কর্মকর্তাদের বলেন সচিব। একই ধরনের বিরোধ তৈরি হয় বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ নিয়েও। এ বিষয়ে মন্ত্রীর সিদ্ধান্ত প্রতিপালন না করে সচিব এককভাবে সিদ্ধান্ত নেন। ফলে দীর্ঘ সময় বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অভাবে গ্রাহক ভোগান্তি চরমে ওঠে বলে অভিযোগ করা হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। এমনকি এই পদে নিয়োগের আগে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া নিয়েও দেখা দেয় বিরোধ। একজনকে দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচিত করা হলেও একক সিদ্ধান্তে আরেকজনকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেন সচিব। এ দায়িত্ব দেওয়ার প্রজ্ঞাপনের কপি মন্ত্রী বা তার পিএসকে দেওয়া হয়নি। মন্ত্রী ও সচিব দুই রকমের সিদ্ধান্ত দেন বিটিসিএলের টেলিকম টাওয়ার প্রজেক্ট নিয়েও। এটি বন্ধ করা নিয়ে কমিটি গঠন করেন সচিব। পরে জানতে পেরে সেই কমিটি বাতিল করেন মন্ত্রী। এতে রোষানলে পড়েন এক অতিরিক্ত সচিব।
আরও অভিযোগে বলা হয়েছে, গত তিন মাসে বিভিন্ন কোম্পানির বোর্ড সভায় দরপত্র অনুমোদনের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা কাজ পায়নি। বরং সর্বনিম্ন দরদাতাকে ছলেবলে নন-রেসপনসিভ বলে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আছে বিটিসিএলের আইসিএক্স ও টেলিটকের ৪জি প্রজেক্টের এন্টেনার মতো দরপত্রও। আবার আর্থিক সংকটে টেলিটক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন না দিতে পারলেও টেলিটকের তহবিল থেকে জোরপূর্বক আইডিয়াল স্কুল ও কলেজের পুনর্মিলনীতে ১০ লাখ টাকা খরচ করে স্টল বানিয়ে সচিবের বই বিক্রিতে বাধ্য করার অভিযোগ আছে।
মন্ত্রী-সচিব বিরোধে মন্ত্রণালয়ের কাজ ক্ষতিগ্রস্ত প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রুল অব বিজনেসে মন্ত্রী ও সচিবের কাজের সীমারেখা চিহ্নিত করা আছে। তাদের এই সীমারেখা মানতেই হবে। এটা যদি কেউ না মানে তাহলে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। জানতে চাইলে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মন্ত্রী-সচিব দুজনই জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করেন। দ্বন্দ্ব জনকল্যাণের জন্য ক্ষতিকর। তাই দ্বন্দ্ব নিরসন হতে হবে। আইনবিধি অনুযায়ী দুজনের কাজ করা উচিত।