কর্ণফুলীর ‘ইউনিয়ন পরিষদ’ এর ওয়েব সাইটের এ কি হাল!
জে. জাহেদ, চট্টগ্রাম প্রতিনিধিঃ
চট্টগ্রাম কর্ণফুলী উপজেলার সংখ্যাগরিষ্ঠ ইউনিয়ন পরিষদের ওয়েব সাইটগুলোর অবস্থা হ-য-ব-র-ল। অধিকাংশই ভুল তথ্যে ভরা। হালনাগাদ হচ্ছে না বছরের পর বছর। অনেক ওয়েব সাইটে স্ব স্ব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সচিবের নাম পর্যন্ত নেই। নেই কোন সঠিক আপডেট তথ্য।
এসব ওয়েবসাইট দেখভালের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কী করছেন- এ প্রশ্ন এখন সবার। এ ধরনের ঘটনা সরকারি শৃঙ্খলার পরিপন্থি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে মত দিয়েছেন সংশ্নিষ্টরা। তাঁদের অভিমত, কিছু দায়িত্বহীন লোকের কারণে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কার্যক্রম ভেস্তে যেতে বসেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি বিধি অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কর্ণফুলীর পাঁচ ইউনিয়ন পরিষদের ৪টি ওয়েব সাইটেই পুরোনো তথ্যে ঠাসা। এতে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন-সঠিক তথ্যপ্রাপ্তির ন্যায্য অধিকার থেকে। সরকারি সেবার বিভিন্ন তথ্য সাধারণ মানুষ অবাধে না জানার ফলে মাঠপর্যায়ে দুর্নীতিও বাড়ছে। একইভাবে ওয়েবসাইটগুলোতে প্রয়োজনীয় তথ্য মিলছে না। এ যেন তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বেহাল দশা। অথচ এগুলো দেখার জন্য প্রতিটি উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সভাপতিত্বে আইসিটি বিষয়ক কমিটি রয়েছে।
তথ্য বলছে, চরপাথরঘাটা ইউনিয়ন পরিষদের ওয়েব সাইটে ‘বর্তমান পরিষদ’ ক্যাটাগরিতে এখনো মেম্বার হিসেবে নাম রয়েছেন পূর্বের ইউপি সদস্য আব্দুর রাজ্জাক, আছিয়া বেগম, জাহাঙ্গীর আলম পাটোয়ারী ও জালাল উদ্দিনের। এদের ওয়ার্ডে নির্বাচত নতুন ইউপি সদস্যের নাম এখনো ওয়েবসাইটে ওঠেনি। বলতে গেলেও চরপাথরঘাটার ওয়েব সাইটে ১১ মাসেও পুর্ণ হয়নি এসব তথ্য হালনাগাদ।
এতে ওয়েব সাইটে আরও গেছে, চরপাথরঘাটা ইউনিয়নে হতদরিদ্রদের তালিকায় রয়েছে-কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলার সুবিল ইউনিয়নের উপকারভোগীদের নামের তালিকা। যা ঝুলিয়ে রেখেছেন বছরের পর বছর। এমনকি ভিজিএফ তালিকাটাও সুবিল ইউনিয়নের। চরপাথরঘাটা এলাকার কোন সুবিধাভোগীর নাম পরিষদ ওয়েব সাইটে নেই। প্রকল্প তালিকা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকাও শূণ্য। আজব কাণ্ড মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ভোগীদের তালিকায় রয়েছে শিকলবাহা ইউনিয়নের ৮ উপকারভোগী।
এছাড়াও বয়স্ক ভাতা ক্যাটাগরিতে রয়েছে ‘সাতকানিয়া উপজেলার পশ্চিম বাজালিয়া গ্রামের ৪ উপকারভোগী। প্রতিবন্ধী ভাতা পাওয়া উপকারভোগীর তালিকায় রয়েছে ‘মীরসরাই উপজেলা ও কুমিল্লা দেবিদ্বারের লোকজন।চরপাথরঘাটা হাটবাজারের তালিকায় রয়েছে-মীরসরাই উপজেলার ওয়াহেদপুর বাজার। যশোর জেলার বুড়িরপাড় বাজার ও কুমিল্লা জেলার সুবিল বাজার। চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের কোন নাগরিক ডিজিটাল সেবা পেতে ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলে থঁ বনে যাচ্ছেন। এ অবস্থা দেখে ইউপি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব জ্ঞান নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
অপরদিকে, চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন পরিষদের ওয়েব সাইটে প্রবেশ করলে নজরে পড়ে চেয়ারম্যানের নামটিও ভুল ভাবে লিখা হয়েছে। কেননা জাতীয় পরিচয়পত্রে চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নাম লেখা আছে মোহাম্মদ সোলায়মান। কিন্তু পরিষদের ওয়েব সাইটে লেখা হয়েছে ‘আলহাজ্ব সোলাইমান তালুকদার’। এমনকি পরিষদ সচিব মো. শাহাদাৎ হোসেন এর নামও ওয়েব সাইটের কোথাও দেখা যায়নি।
পুরো ওয়েবসাইট ঘুরে আরও দেখা গেছে, চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের হতদরিদ্র ও ভিজিএফ তালিকায়ও কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলার সুবিল ইউনিয়নের উপকারভোগীদের নাম ও তালিকা। চরলক্ষ্যা ইউনিয়নে শুধুমাত্র ৪ জন নারী বিধবা ভাতা পান বলে উল্লেখ্য রয়েছে। মাতৃত্বকালীন ভাতা ভোগীদের তালিকায় রয়েছে ২০১৪-১৫ ইং সালের সুবিধাভোগীদের ডাটাবেজ।
অন্যদিকে, বড়উঠান ইউনিয়ন পরিষদ এর সাইটটি সাজানো হয়েছে অসাধারণ একটি থিম দিয়ে। নৌকা প্রতীকে লেখা রয়েছে ‘গ্রাম হবে শহর’। অনলাইনে নেওয়া হয়েছে সকল সেবা। বড়উঠানের যে কোন নাগরিক তার নাগরিক সনদ, ওয়ারিশ সনদ, পারিবারিক সনদ, চারিত্রিক সনদ, ভূমিহীন সনদ, প্রত্যয়ন সনদ, মৃত্যু সনদ, ট্রেড লাইসেন্স টসহ সব কিছু অনলাইনে আবেদন করলেই পেয়ে যাচ্ছেন। যা আর কোন ইউনিয়নের ওয়েব সাইটে দেখা যায়নি।
তবে বড়উঠান ইউনিয়ন পরিষদের সাইটে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় কারো নাম পাওয়া যায়নি। ভিজিডি ভাতা, বয়স্ক ভাতা, মাতৃত্যকালিন ভাতা, বয়স্ক ভাতা, দুস্থ ও দরিদ্র ভাতা, বিধবা ভাতা, ও প্রতিবন্ধী ভাতা গ্রহণকারীদের তালিকাও কারো নাম পাওয়া যায়নি। এমনকি জনপ্রতিনিধি ক্যাটাগরিতে কোন ইউপি সদস্যদের নাম দেখা যায়নি। ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যাক্তা মো. ফারুক ‘উদ্যাক্তা ক্যাটাগরি’তে নিজের নামটিও লিপিবদ্ধ করেননি। তবে তিনি শিগগরই সকল তথ্য হালনাগাদ করবেন বলে জানান।
জুলধা ইউনিয়নের ওয়েব সাইটে প্রবেশ করতে চাইলে বার বার কম্পিউটার স্কিনে প্রদর্শিত হতে দেখা গেছে “Sorry, the page you are looking for could not be found” এই মেসেজটি। জুলধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারমান কিংবা ইউপি সদস্যদের কারো নাম ওয়েব সাইটে নেই। বরং দেখা গেছে, মাত্র তিনজন ব্যক্তি জুলধায় বয়স্ক ভাতা পান। প্রতিবন্ধী ভাতার তালিকায় আবারও মীরসরাই উপজেলার ওয়াহেদপুর, যশোর জেলার বুড়িরপাড় ও কুমিল্লা জেলার সুবিল ইউনিয়নের উপকারভোগীদের তালিকা শোভা পেতে দেখা গেছে।
সর্বশেষ শিকলবাহা ইউনিয়ন পরিষদ এর ওয়েব সাইটে দেখা গেছে সকল তথ্য হালনাগাদ রয়েছে। সুবিধাভোগীদের তালিকায় হতদরিদ্র, ভিজিএফ, মাতৃত্বকালীন ভাতা, ভিজিডি, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রী ভাতার আপডেট তথ্য ওয়েব সাইটে প্রদর্শিত হচ্ছে। কোন ধরনের তথ্য অসম্পূর্ণ দেখা যায়নি। এজন্য প্রশংসার পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম ও উদ্যোক্তা আরিফ সালেহ্ তুহিন।
কর্ণফুলী এলাকার স্থানীয় লোকজনেরা বলছেন, শিকলবাহা ইউনিয়ন পরিষদের মতো যদি সকল পরিষদ তাঁদের ওয়েবসাইটে তথ্য হালনাগাদ রাখতেন। তবে সাধারণ নাগরিকরা সহজেই ডিজিটাল সেবা ও সুবিধা পেতেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর্ণফুলীর এক ইউপি সচিব বলেছেন, ‘জবাবদিহিতা এবং দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য ডিজিটাল পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই। এই পদ্ধতি চালু হলে সরকারি ফাইল আর গায়েব হওয়ার সুযোগ থাকবে না, নষ্টও হবে না। শত বছর পরও ফাইল খুঁজে পাওয়া যাবে।’
কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী তানিম হোসেন বলেন, ‘আসলে এই সমস্যা বর্তমান প্রজন্মের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা সহজেই বুঝবেন, তথ্য প্রযুক্তির যুগে তথ্য আদান-প্রদানকৃত সকল তথ্য সাইট আপডেট রাখা জরুরী। চেয়ারম্যান ও উদ্যোক্তারা চাইলেই সহজেই তা সম্ভব। দরকার সৎ উদ্যাগ আর দায়িত্ববান হওয়া।’
বড়উঠান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, ‘ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্রগুলো ২০০৭ সালে ‘কমিউনিটি ইনফরমেশন সেন্টার’ (সিইসি) নামে শুরু হয়। বর্তমানে সারাদেশে ৪ হাজার ৫০১টি ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র রয়েছে। ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কার্যালয় থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এসব ডিজিটাল সেন্টার একযোগে উদ্বোধন করেন এবং পরবর্তীতে এর নাম দেওয়া হয় ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। আমার ইউনিয়নের সকল সেবা ডিজিটাল করা হচ্ছে। ৯০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।’
কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মো. মামুনুর রশীদ বলেন,‘বিষয়টি আমরাও লক্ষ্য করেছি। গত কয়েকদিন আগে স্ব স্ব দফতরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। ডিজিটাল সেন্টার বা পরিষদের উদ্যোক্তারা না পারলে প্রয়োজনে আমাদের প্রোগ্রামার হেল্প করবেন। ওয়ে সাইটের সকল ক্যাটাগরিতে আপডেট তথ্য সংযোজন করা হবে শিগগরই।’
এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মোঃ আবদুল মালেক জানান, ‘ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপিত তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর একটি অত্যাধুনিক তথ্য ও জ্ঞানকেন্দ্র (টেলিসেন্টার)। যার উদ্দেশ্য হলো তৃণমূল মানুষের দোরগোড়ায় তথ্যসেবা নিশ্চিত করা। এ কেন্দ্র থেকে গ্রামীণ জনপদের মানুষ খুব সহজেই তাদের বাড়ীর কাছে পরিচিত পরিবেশে জীবন ও জীবিকাভিত্তিক তথ্য ও প্রয়োজনীয় সেবা পায়। এসব কেন্দ্রের উচিত ইউনিয়নের সকল তথ্য আপডেট রাখা। কর্ণফুলী উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উদ্যোক্তাদের এ বিষয়ে জানানো হবে।’