আইপিএল: যে পাঁচ কারণে ধোনির চেন্নাইয়ের নাটকীয় শিরোপা জয়
পঞ্চমবারের মতো আইপিএল শিরোপা জিতে ইতিহাসে জায়গা করে নিল চেন্নাই সুপার কিংস। মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের সমান পাঁচবার শিরোপা জিতল মহেন্দ্র সিং ধোনি নেতৃত্বাধীন চেন্নাই।
গুজরাটের আহমেদাবাদে নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে ১ লাখ দর্শক স্থানীয় সময় সোমবার দিবাগত রাত দুইটা পর্যন্ত এই খেলা দেখেছে। শেষ ওভারের নাটকীয়তায় চেন্নাইয়ের জয় নিশ্চিত করেছেন রবীন্দ্র জাদেজা।
সোমবার রাতে টসে জিতে বল করার সিদ্ধান্ত নেয় চেন্নাই। গুজরাট টাইটান্স ২১৪ রান তোলে শুরুতে ব্যাট করে। এরপর চেন্নাইয়ের ইনিংস শুরু হতে না হতেই নামে বৃষ্টি। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় খেলা বন্ধ ছিল বৃষ্টির কারণে। এরপর চেন্নাইয়ের জন্য নতুন টার্গেট দাঁড়ায় ১৫ ওভারে ১৭১।
তবে দুর্দান্ত পারফর্ম্যান্সে ম্যাচ জিতে শিরোপা ঘরে তুলেছে চেন্নাই। চেন্নাইয়ের এখন পাঁচটি আইপিএল শিরোপা, অধিনায়ক হিসেবে মহেন্দ্র সিং ধোনিরও তাই।
এই ফাইনাল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল রবিবার রাতে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে রিজার্ভ ডেতে গড়ায় খেলা।
আসুন জেনে নেওয়া যাক কোন পাঁচ কারণে নাটকীয়ভাবে শিরোপা জিতল চেন্নাই।
বৃষ্টি বড় ফ্যাক্টর
খেলায় যখন বৃষ্টির বিরতি তখন অনেকেই খাতা কলম নিয়ে বসেছিল, বৃষ্টিতে ওভার কাটা পড়লে কত হবে চেন্নাইয়ের নতুন টার্গেট।
এর মাঝে ভারতের স্পিনার রাভিচান্দ্রান আশ্বিন টুইট করেন, “যাই হোক না কেন, কাটা ওভারের খেলায় এই উইকেটে ও পিছল আউটফিল্ডে চেন্নাই সুবিধা পাবেই।”
শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে, ১৫ ওভারের খেলা মানে উইকেট হারানোর ভয় কম, কম ওভারে দ্রুত রান তোলার কাজটা চেন্নাই সহজেই করেছে।
সোমবার রাতে আহমেদাবাদে শুধু বৃষ্টিই হয়নি মোটামুটি একটা ঝড় বয়ে গেছে, এই ঝড়ের পর ব্যাট হাতে ঝড় তুলেছেন চেন্নাইয়ের ব্যাটাররা।
চেন্নাই সুপার কিংস এবার যে মাঠেই খেলেছে, যে রাজ্যেই গিয়েছে তুমুল সমর্থন পেয়েছে মহেন্দ্র সিং ধোনির জন্য, রবিবার আইপিএল ফাইনাল ম্যাচ স্থগিত হওয়ার পর অনেক চেন্নাই ভক্ত আহমেদাবাদে রেলস্টেশনে রাত কাটিয়েছেন, টুইটারে এসব ছবি ঘুরছিল সারাদিন।
এই সমর্থকদের প্রতিদান দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ বলে বলেছেন চেন্নাই অধিনায়ক ধোনি।
রাহানে-রাইডুর প্রতিদান
চেন্নাই সুপার কিংস একটা ভিন্ন তরিকায় আইপিএলে দল ম্যানেজ করে, কোনও ক্রিকেটার এক বা দুই ম্যাচে ব্যর্থ হলেই তাকে একাদশ থেকে বের করে দেয় না, এটা দলে একটা সমন্বয় তৈরিতে সাহায্য করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ভারতের জনপ্রিয় উপস্থাপক হারশা ভোগলে টুইটারে লিখেছেন, “একে বলে ভরসা রাখার শক্তি, কে ভেবেছিলেন এমন শক্তির প্রদর্শন করবেন রাহানে ও রাইডু।”
আজিঙ্কা রাহানে ভারতে টেস্ট ব্যাটার হিসেবেই বেশি পরিচিত। অন্যদিকে আম্বাতি রাইডু আইপিএলের সিনিয়র একজন সদস্য।
ফাইনালে এই দু’জন মিলে ২১ বলে ৩৬ রান তোলেন।
আজিঙ্কা রাহানে তোলেন ১৩ বলে ২৭ রান, ২ টি ছক্কা হাঁকান এই ভারতীয় ব্যাটার।
আম্বাতি রাইডু মূলত চেন্নাইকে ম্যাচে ফেরান ১৩তম ওভারে যখন ১৮ বলে ৩৯ রান প্রয়োজন তখন তিনি মোহিত শর্মার টানা তিন বলে ৬,৪,৬ মেরে ব্যবধান কমিয়ে আনেন।
শুভমান গিলের আউট
শুভমান গিল আইপিএলের শেষভাগে যেমন খেলছিলেন তাতে এই ব্যাটারকে স্বাভাবিক উপায়ে আউট করা কঠিন হয়ে পড়েছিল, তাই মহেন্দ্র সিং ধোনি মিলিসেকেন্ডের নৈপুণ্যে তাকে প্যাভিলিয়নে ফেরালেন।
শুভমান গিল শুরু করেছিলেন আগের মতোই, ১৯ বলে ৩৯ তুলে নিয়েছিলেন, রবীন্দ্র জাদেজার একটি বল গিল মিস করেন। আর তখনই ধোনি আলোর গতিতে স্ট্যাম্প ভেঙে দেন।
সঞ্জয় মানজেরেকার ইএসপিএন ক্রিকইনফোর বিশ্লেষণে বলেন, এটা অবিশ্বাস্য ছিল। ধোনির চেয়ে দ্রুত স্ট্যাম্পিং কেউই করতে পারে না এটা আমরা সবাই জানি, ধোনি টেকনিকের ধার ধারেননি হাত রেখেছেন স্ট্যাম্পের কাছে এবং স্ট্যাম্প ভেঙে দেন, জাদেজা হাসছিলেন, গিল তখন ক্রিজের বাইরে।”
টুইটারে ভারতের সাবেক ক্রিকেটার বীরেন্দর সেহওয়াগ লিখেছেন, “আপনি ভারতে ব্যাংকে গিয়ে ব্যাংক নোট বদলাতে পারবেন। কিন্তু ধোনিকে কেউ বদলাতে পারবেন না, তার চেয়ে দ্রুত কেউ নেই।”
মহেন্দ্র সিং ধোনি এই মৌসুমে ব্যাট হাতে তেমন ভূমিকা রাখেননি, তিনি ভূমিকা রেখেছেন অধিনায়ক হিসেবে এবং ফাইনালের মতোই উইকেটের পেছন থেকে।
ম্যাচ শেষে ধোনি প্রেজেন্টেশনে গিয়ে হারশা ভোগলেকে বলেন, “আমি তো ধরেই রেখেছিলাম এটাই আমার শেষ আইপিএল হতে যাচ্ছে কিন্তু যে ভালোবাসা আমি ভারতজুড়ে পেয়েছি সেটা অবিশ্বাস্য।”
“আমি আরও ছয় সাত মাস দেখি, যদি শরীর সায় দেয় আমি আবারও খেলব।”
আর কিছুদিন পরেই ধোনির বয়স হতে চলেছে ৪২।
ধোনির কাছে এই আইপিএল শিরোপা ছিল বিশেষ কিছু, শেষ দুই বল তিনি ডাগআউটে চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন, জাদেজার উইনিং শটের পর তাকে কোলে তুলে নেন ধোনি।
শ্রীলঙ্কার সাবেক অধিনায়ক অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজ টুইট করেন, “যে ভালোবাসা ধোনি পাচ্ছেন তা অবিশ্বাস্য, এটা প্রমাণ করে কত বড় ব্যক্তিত্ব তিনি।”
গুজরাট বোলারদের ব্যর্থতা
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ ২০২৩ এর সফল দুই বোলার মোহাম্মদ শামি ও রশিদ খান ফাইনালে উইকেট পাননি। রশিদ খান ৩ ওভারে ৪৪ রান হজম করেছেন, যা তার নামের পাশে বেমানান।
মোহিত শর্মা ৩টি উইকেট নিয়েছেন বটে কিন্তু তিনি শেষ দুই বলে লাইন মিস করেন, জাদেজার যখন এক বলে চারের জন্য দাঁড়িয়েছেন তখন তিনি পায়ে ফুল্টস দেন, যা জাদেজা সহজেই বাউন্ডারি পার করান।
সাই সুদর্শনে মুগ্ধতা
গুজরাট টাইটান্সের ২১৪ রানের সংগ্রহের হাইলাইটস ছিলেন সাই সুদর্শন। ভারতীয় ক্রিকেটার বাদ্রিনাথ টুইটারে লেখেন, “সুদর্শনের ভিত্তিমূল্য ছিল মাত্র ২০ লাখ রুপি, এখন তাকে অমূল্য মনে হচ্ছে।”
ভারতের কিংবদন্তি ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকার টুইটারে লিখেছেন, “সুদর্শনের ব্যাটিং চোখের জন্য প্রশান্তিদায়ক।” ভারতের আরেক সাবেক ক্রিকেটার ইরফান পাঠান টুইটারে মনে করিয়ে দিলেন, “এর আগে আইপিএলে কখনওই ১৫০ এর বেশি স্ট্রাইক রেটে খেলেননি সুদর্শন।”
ফাইনালে খেললেন ৪৭ বলে ৯৬ রানের ইনিংস, স্ট্রাইক রেট ২০০ এরও বেশি। শেষের দিকে নাটকীয়তা
১৫ ওভারে ১৭১ রাঙের টার্গেটে একটা পর্যায়ে দাঁড়ায় ১৮ বলে ৩৯ রানে ১৩তম ওভারে প্রথম তিন বলে দুই ছক্কা ও এক চার হজম করেন মোহিত শর্মা এরপর টানা দুই বলে আম্বাতি রাইডু ও মহেন্দ্র সিং ধোনিকে আউট করে দেন তিনি।
কিন্তু সেখানে নাটকীয়তা শেষ হয়নি, ১২ বলে যখন ২২ রান দরকার, ১৪তম ওভারে মাত্র আট রান দিয়ে গুজরাটকে ম্যাচে ফেরান মোহাম্মদ শামি।
শেষ ওভারে চেন্নাইয়ের জয়ের জন্য প্রয়োজন ১৪ রান, দারুণ চার বল করার পর শেষ দুই বলে ছয় ও চার হজম করেন মোহিত। চেন্নাইয়ের শিবাম দুবেও অবদান রেখেছেন এই ম্যাচে, তিনি ২১ বলে অপরাজিত ৩২ রানের ইনিংস খেলেছেন।
ম্যাচ শেষে রবীন্দ্র জাদেজা বলেন, “আমরা আমাদের এই শিরোপা ধোনিকে উৎসর্গ করছি।”
রানার আপ দলের অধিনায়ক হার্ডিক পান্ডিয়া বলেছেন, “আমি হেরেছি, খারাপ লাগছে কিন্তু ধোনির কাছে হেরেছি তাই আমি মনে করি এতে কোনও সমস্যা নেই।” হার্ডিক পান্ডিয়ার ক্যারিয়ারে ধোনি বড় মেন্টরদের একজন। সূত্র: বিবিসি বাংলা