কর্ণফুলীতে আতঙ্কের নতুন নাম সুইচ গিয়ার ছুরি!
জে. জাহেদ, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:
চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেছে কিশোরদের ‘গ্যাং কালচার’। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোররা ব্যবহৃত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অপরাধের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে খুনাখুনিসহ নানা অপরাধে কিশোর-তরুণরা জড়িয়ে পড়ছে। মাদক ব্যবসা ও জমি দখলবাজিতেও তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে।
কর্ণফুলী উপজেলা কিশোর, যুব গ্যাং প্রতিরোধ কমিটির একাধিক সদস্যরা জানান, ‘মূলত কর্ণফুলীর অলিগলিতে পুলিশের টহল জোরদার কম, পুরা উপজেলার ক্রাইম জোন গুলো সিসিটিভির আওতাভূক্ত না থাকা এবং কিশোর দল দলবদ্ধ হলেই পুলিশ আটক করে শরীর তল্লাশি অভিযান না করায় এ সমস্যা প্রবল আকার ধারণ করেছে।’
জানা যায়, বর্তমানে কর্ণফুলীতে সুইচ গিয়ার ছুরি এক আতঙ্কের নাম। এটি ভাজ করে রাখা যায়, সুইচ টিপলে বের হয়ে আসে ধারালো ফলাটি। আকারে ছোট ৬ ইঞ্চির স্টিলের এই ছুরি দিয়ে প্রতিনিয়ত ঘটছে ছুরিকাঘাত, ছিনতাই ও খুনের মতো ঘটনা। সহজে পকেটে বহন করা যায় বলে এই ধরনের ছুরি এখন খুনি এবং উঠতি বয়সী কিশোর গ্যাং ছেলেদের হাতে দেখা যায়।
কর্ণফুলীর বিভিন্ন স্থানে এই সুইচ গিয়ার ছুরি/টিপ ছোরার ব্যবহার নিয়ে এখন থানা পুলিশও বেশ উদ্বিগ্ন। কেননা, এ ধরনের ছুরি খুব ধারালো, পকেটে ভাজ করে নিরাপদে হাটা যায় বলে অপরাধী এবং কিশোর গ্যাংয়ের সদ্যসরা বর্তমানে এই ছুরির খুব বেশি ব্যবহার করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে চীনের তৈরি এসব ছুরির একপাশ ধারালো। তবে, এগুলো দিয়ে ফল বা সবজি কাটা বা অন্য কোনো কাজে লাগে না। চট্টগ্রামের রেয়াজউদ্দিন বাজার বা ফুটপাতের বিভিন্ন দোকানে হাত বাড়ালেই মেলে এই টিপ ছুরি। ছুরির ডিজাইন ভেদে প্রতিটি ছুরি ৪০০ থেকে হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে এই ছুরি বেচাকেনা করতে দেখা গেছে। এমনকি দারাজ, আলিবাবাসহ বিভিন্ন দেশী বিদেশী অনলাইন শপ থেকে কুরিয়ার যোগে এসব সুইচ গিয়ার ছুরি কিনে থাকেন যুবকরা।
গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এই জাতীয় ছুরি দিয়ে গত ৬-৭ বছর ধরে চট্টগ্রামে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। শহর কিংবা গ্রাম সব জায়গায় ছড়িয়েছে এটি। তবে কিছু ঘটনার পর পুলিশের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে এসব ছুরি বিক্রির ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। তারপরও গোপনে এই ছুরি বিক্রি হচ্ছে।
মহানগর গোয়েন্দা (পশ্চিম ও বন্দর) বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, ‘এই সুইচ গিয়ার ছুরিগুলো বাইরের দেশ থেকে আসে, সে ক্ষেত্রে কী নাম দিয়ে এগুলো আমদানি হয়, কীভাবে খালাস হয়, কারা আমদানি করে, কাস্টমস কীভাবে ছাড় দেয় তা খতিয়ে দেখা হবে।’
কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ দুলাল মাহমুদ বলেন, ‘টিপ ছুরি বিক্রি নিষিদ্ধ। নতুন নাম শোনলাম সুইচ গিয়ার চূরি। আমরা এ ধরনের আসামি ধরা পড়ার পর তাদের জিজ্ঞেস করি কোথা থেকে তারা তা সংগ্রহ করেছে। এরপরে আমরা তাদের নিয়ে সেখানে অভিযান চালাই এবং আইনের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছি।’
‘পাশাপাশি কর্ণফুলীর অলিগলিতে পুলিশের টহল জোরদার, উপজেলার ক্রাইম জোন গুলো সিসিটিভির আওতাভূক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। পুলিশ কাজও করছেন। তখন মনিটরিং করা আরও সুবিধা হবে।’
সিনিয়র আইনজীবি ও মানবাধিকার কর্মী জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘কিশোর গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা পর্যায়ক্রমে আলাদা আলাদা গ্রুপ তৈরি করে। তাদের আলাদা হেয়ার স্টাইল থাকে, তাদের চালচলনও ভিন্ন। তারা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। তারা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। নানাভাবে তারা অর্থ আয়ের চেষ্টা করে।’
প্রসঙ্গত, কর্ণফুলীতে গত পাঁচ বছরে (২০১৮-২০২২) ৯ টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। হামলার ঘটনা ঘটেছে একাধিক। হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন ১০ জন। নিহতদের অধিকাংশই যুবক। আহতদের বেশির ভাগ কিশোর। খুনের ঘটনায় আসামিদের ৯০ শতাংশই আবার কিশোর গ্যাং সদস্য বলে তথ্য উঠে এসেছে।