ডেঙ্গু নিয়ে কিছু কথা
সম্ভাব্য ডেঙ্গু জ্বরের ঘটনার প্রথম বিবরণ পাওয়া জিন বংশের (২৬৫-৪২০ খ্রিস্টাব্দ) এক চীনা মেডিকেল এনসাইক্লোপিডিয়ায় (বিশ্বকোষ)। যেখানে উড়ন্ত পতঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ‘জলীয় বিষ’-এর কথা বলা হয়েছে। সতের শ’ শতাব্দীর এক মহামারির বিবরণও পাওয়া যায়, কিন্তু ডেঙ্গু মহামারির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রথম বিবরণ পাওয়া যায় ১৭৭৯ ও ১৭৮০তে, যখন এক মহামারির কবলে পড়েছিল এশিয়া, আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকা। তখন থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত মহামারি অনিয়মিত ছিল।
১৯০৬ সালে ‘এডিস ইজিপ্তাই’ মশার পরিবাহিতা সম্পর্কে সবাই নিশ্চিত হয়, এবং ১৯০৭ সালে ভাইরাসঘটিত রোগের মধ্যে ডেঙ্গু হয়ে ওঠে দ্বিতীয় (ইয়েলো ফিভার-এর পরেই)। জন বার্টন ক্লেল্যান্ড এবং জোসেফ ফ্র্যাঙ্কলিন সিলার আরও গবেষণা চালিয়ে ডেঙ্গু পরিবাহিতার মূল প্রতিপাদ্য সম্পূর্ণ করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ও তারপর ডেঙ্গুর লক্ষণীয় বিস্তারের কারণ হিসেবে পরিবেশগত ধ্বংসের কথা বলা হয়। একই প্রবণতা রোগের বিবিধ সেরো টাইপের নতুন নতুন এলাকা বিস্তারে এবং ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভারের উদ্ভবে দেখা যায়। রোগের এ চরম রূপের বিবরণ ১৯৫৩ সালে প্রথম ফিলিপাইনে পাওয়া যায়; ১৯৭০-এ এটি শিশু মৃত্যুর এক প্রধান কারণ হয়ে ওঠে এবং আমেরিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ১৯৮১ সালে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম প্রথম পরিলক্ষিত হয়,যখন অনেক বছর আগের DENV-1 আক্রান্তরা DENV-2 তে আক্রান্ত হয়।
শব্দের উদ্ভব
‘ডেঙ্গু’ শব্দের উদ্ভব পরিষ্কার নয়, তবে একটা মত হলো এটি এসেছে Swahili শব্দবন্ধ কা-ডিঙ্গা পেপো, যার অর্থ দুষ্ট আত্মার কারণে ঘটিত রোগ। সোয়াহিলি শব্দ ‘ডিঙ্গা’ খুব সম্ভব স্পেনীয় শব্দ ‘ডেঙ্গু’র মূলে আছে যার অর্থ খুঁতখুঁতে বা সাবধানী, যা ডেঙ্গু জ্বরের হাড়ের ব্যথায় আক্রান্ত ব্যক্তির চলনকে বর্ণনা করে। তবে এটাও সম্ভব যে এ স্পেনীয় শব্দের ব্যবহার একই উচ্চারণের সোয়াহিলি থেকে এসেছে। বলা হয়, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রীতদাসদের মধ্যে যাদের ডেঙ্গু হতো তাদের ভঙ্গিমা ও চলন ডান্ডি (নৌকা)র মতো হয়ে যেত আর তাই রোগটি ‘ডান্ডি জ্বর’ নামে পরিচিত ছিল। ‘ব্রেক বোন ফিভার’ শব্দটি প্রথম প্রয়োগ করেন পদার্থবিদ ও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বেঞ্জামিন রাশ, ১৭৮০ সালের ফিলাডেলফিয়ার মহামারির ওপর ১৭৮৯ সালে লিখিত এক রিপোর্টে। রিপোর্টে তিনি মূলত ‘বিলিয়াস রেমিটিং ফিভার’ শব্দটি ব্যবহার করেন। ১৮২৮ এর পর ডেঙ্গু জ্বর শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। অন্যান্য ঐতিহাসিক শব্দের মধ্যে আছে ‘ব্রেকহার্ট ফিভার’ এবং ‘লা ডেঙ্গু’। প্রবল রোগের শব্দাবলির মধ্যে আছে ‘ইনফেকচুয়াস থ্রম্বোসাইটোপেনিক পার্পারা’ এবং ‘ফিলিপাইন’, ‘থাই’ বা ‘সিঙ্গাপুর হেমোরেজিক ফিভার’।
ডেঙ্গুজ্বর (সমার্থক ভিন্ন বানান ডেঙ্গি) একটি এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সচরাচর ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশিতে ও গাঁটে ব্যথা এবং গাত্রচর্মে ফুসকুড়ি। দুই থেকে সাত দিনের মাঝে সাধারণত ডেঙ্গু রোগী আরোগ্য লাভ করে। [১] কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক রক্তক্ষরী রূপ নিতে পারে যাকে ডেঙ্গু রক্তক্ষরী জ্বর (ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার) বলা হয়। এর ফলে রক্তপাত হয়, রক্ত অনুচক্রিকার মাত্রা কমে যায় এবং রক্ত প্লাজমার নিঃসরণ ঘটে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কখনোবা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম দেখা দেয়। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে যায়। [২]
কয়েক প্রজাতির এডিস মশকী (স্ত্রী মশা) ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক। যেগুলোর মধ্যে এডিস ইজিপ্টি মশকী প্রধানতম। ভাইরাসটির পাঁচটি সেরোটাইপ পাওয়া যায়। ভাইরাসটির একটি সেরোটাইপ সংক্রমণ করলে সেই সেরোটাইপের বিরুদ্ধে রোগী আজীবন প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে, কিন্তু ভিন্ন সেরোটাইপের বিরুদ্ধে সাময়িক প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে। [১] পরবর্তীতে ভিন্ন সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমিত হলে রোগীর মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। কয়েক ধরনের টেস্টের মাধ্যমে, যেমন, ভাইরাসটি বা এর আরএনএ প্রতিরোধী এন্টিবডির উপস্থিতি দেখেও ডেঙ্গুজ্বর নির্ণয় করা যায়।
ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধী টিকা কয়েকটি দেশে অনুমোদিত হয়েছে তবে এই টিকা শুধু একবার সংক্রমিত হয়েছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে কার্যকর। মূলত এডিস মশার কামড় এড়িয়ে চলাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। তাই মশার আবাসস্থল ধ্বংস করে মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করতে হবে। এ জন্য এডিস মশার বংশবিস্তারের উপযোগী বিভিন্ন আধারে, যেমন- কাপ, টব, টায়ার, ডাবের খোলস, গর্ত, ছাদ ইত্যাদিতে আটকে থাকা পানি অপসারণ করতে হবে। [১] শরীরের বেশিরভাগ অংশ ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরিধান করতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বর হলে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে এবং বেশি করে তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে। জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল দেওয়া হয়। প্রায়শ রোগীর শিরায় স্যালাইন দিতে হতে পারে। মারাত্মক রূপ ধারণ করলে রোগীকে রক্ত দিতে হতে পারে। ডেঙ্গু জ্বর হলে কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ও ননস্টেরয়েডাল প্রদাহপ্রশমী ওষুধ সেবন করা যাবে না, করলে রক্তপাতের ঝুঁঁকি বেড়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে ডেঙ্গু একটি বৈশ্বিক আপদে পরিণত হয়েছে। এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও অন্যান্য মহাদেশের ১১০টির অধিক দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হয়। প্রতি বছর পাঁচ থেকে পঞ্চাশ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে সংক্রমিত হয় এবং তাদের মাঝে ১০ থেকে ২০ হাজারের মতো মারা যায়। ১৭৭৯ সালে ডেঙ্গুর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। বিংশ শতকের প্রথমভাগে ডেঙ্গুর ভাইরাস উৎস ও সংক্রমণ বিশদভাবে জানা যায়। মশক নিধনই বর্তমানে ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। সরাসরি ডেঙ্গু ভাইরাসকে লক্ষ্য করে ওষুধ উদ্ভাবনের গবেষণা চলমান রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশটি অবহেলিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগের একটি হিসেবে ডেঙ্গু চিহ্নিত করেছে।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইএনটি, সিলেট এমএজি মেডিকেল কলেজ, সিলেট