চট্টগ্রামে সাড়ে ৬ লাখ গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হাতের ইশারায় সিগন্যাল বাতি আছে কিন্তু জ্বলে না!
জে. জাহেদ, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:
চট্টগ্রাম নগরীর সড়ক জুড়ে মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি থাকলেও তাতে আলো জ্বলে না। ফলে হাতের ইশরায় চলছে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ। এতে সড়কে যেমন যানজট লেগেই থাকে তেমনি ট্রাফিক সদস্যদের করতে হয় বাড়তি কষ্ট। ডিজিটাল এই যুগে যেখানে পুরো পদ্ধতি স্বয়ংক্রিয় হওয়ার কথা ছিল, সেখানে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে হাতের ইশারায়।
জানা যায়, শহরের সড়কগুলোতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ২০১৯ সালে বসানো হয়েছিল স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল লাইট। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কয়েক বছর ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে তা। চরম অব্যবস্থাপনার ফলে চট্টগ্রাম মহানগরীতে যানজট বাড়ছে।
তথ্য পাওয়া যায়, নিয়মানুযায়ী সিগন্যাল লাইট রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। কিন্তু সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে ট্রাফিক বিভাগের মন্তব্য। যদিও যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশ এখনো হাতের ইশারায় আর বাঁশি ফুঁকে নিয়ন্ত্রণ করে যান চলাচল। তাঁদের সামনেই আলোর অভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি।
নগরীর ব্যস্ততম সড়ক আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, লালখানবাজার, কাজীর দেউড়ি, জিইসি, দুই নম্বর গেট, মুরাদপুর-বহদ্দারহাটের অনেক সড়কে ট্রাফিক সিগন্যাল পয়েন্টে অকেজো সিগন্যাল বাতি। সেই সাথে অকেজো টাইম কাউন্টডাউন যন্ত্র। নগরীর ৪৬ টি গুরুত্বপূর্ণ প্রধান সড়কে ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি আছে, কিন্তু এই বাতির আলো জ্বলে না।
কাজীর দেউড়ি সিগন্যাল পয়েন্টে দেখা যায়, ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের হাতে থাকা সংকেত বাতিতে লাল আলো জ্বললেও সেই আলো উপেক্ষা করে এগিয়ে চলছে গাড়ির সারি। গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ। গাড়ির চালক বা ট্রাফিক পুলিশ কেউই খেয়াল রাখছে না দাঁড়িয়ে থাকা সিগন্যাল বাতির দিকে। লাল-হলুদ-সবুজ যে বাতিই থাকুক না কেন, আলোর অভাবে গাড়ি চালকরা অপেক্ষা করছে ট্রাফিক সদস্যদের হাত উঁচিয়ে সংকেত দেওয়ার দিকে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, চট্টগ্রামের রাস্তায় ১৭টি রুটে চলাচলকারী প্রায় সাড়ে ৬ লাখ গাড়ি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে হাতের ইশারাতেই। নগরীর যানজট নিরসনে সরকার একের পর এক প্রকল্প গ্রহণ করলেও তা সমন্বয়হীনতার অভাবে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ প্রজেক্টের কর্মকর্তাদের বেতনভাতা ঠিকঠাক চললেও অচল রয়েছে সিগন্যাল পয়েন্টের বাতি। অথচ সেই দায় সুকৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। ফলে দিন দিন নগরীতে যানজট অসহনীয় হারে বাড়ছে।
বিআরটিআর তথ্য হিসেবে চট্টগ্রামে তিন লাখ ৩৭ হাজার ১৬১টি যানবাহন চলাচল করে। এর বাইরে রিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশা আছে তিন লাখের বেশি। জনসংখ্যা ও যানবাহন অনুপাতে যে পরিমাণ সড়ক থাকার কথা, তা ৬০ বর্গকিলোমিটারের আয়তনের চট্টগ্রামে নেই। এমনটি জানিয়ে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (যানবাহন) আবদুল মান্নান মিয়া বলেন, যেকোনো শহরে যানবাহন চলাচলের জন্য অন্তত ২৫ শতাংশ রাস্তা থাকা দরকার। সেখানে চট্টগ্রামে আছে ৭ থেকে ৮ শতাংশ।
নগরীর বিভিন্ন মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি গাড়ি চলাচল করে রাস্তাঘাটে। অন্যদিকে মানুষের মধ্যে সিগন্যাল দেখে চলা বা আইন মানার প্রবণতা নেই। তাই বাধ্য হয়েই হাতের ইশারায় যান নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে। গাড়ির সাথে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। এটা দেখার কেউ নেই। আমাদের কষ্ট বুঝলে এতদিন এভাবে অকেজো পড়ে থাকে না সড়কবাতিগুলো। দেশ নাকি ডিজিটাল হচ্ছে!
সিএমপির ট্রাফিক বিভাগ বলছেন, প্ল্যানিং, ইঞ্জিনিয়ারিং, এডুকেশন ও এনফোর্সমেন্ট— এ চার ভাগে ট্রাফিকের কাজ হয়। এর মধ্যে প্রথম তিনটি ভাগ পরিচালনার কাজ চসিকের। এনফোর্সমেন্টের কাজটা শুধু পুলিশ করে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে হয়তো চারজন ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু এই চারজনের পক্ষে যতগুলো গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, তার চেয়ে অনেক বেশি গাড়ি চলাচল করে রাস্তায়।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) আবদুল মান্নান মিয়া বলেন, ‘শহরের ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি গুলো সচলের বিষয় নিয়ে চসিকের সাথে কথা হয়েছে। কাজটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। শিগগিরই একটা ব্যবস্থা হচ্ছে। এতটুকু বলতে পারি।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সচিব খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘আমি একটা জরুরী মিটিং এ আছি। এ বিষয়ে কথা বলার দায়িত্ব আমাদের সিটি করপোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ঝুলন কান্তি দাশ সাহেবের। আপনারা উনার সাথে কথা বলুন।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ঝুলন কান্তি দাশ বলেন, ‘ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি নিয়ন্ত্রণের দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ ট্রাফিক বিভাগের, আমাদের না। এ নিয়ে আমাদের কোনো বাজেটও নেই। এমনকি সিগন্যাল বাতি নিয়ে মেয়র মহোদয়ের একটা অবজারভেশন আছে। যদি মেয়র মহোদয়ের ইন্সট্রাকশন পাই, তাহলে বাতি সচলের জন্য কাজ করতে পারি।’
অপরদিকে, এ বিষয়ে কথা বলতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর মুঠোফোনে দুই দিন যাবত কল দিলেও ফোন রিসিভ না করায় মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, বন্দরনগরীতে প্রথম সিগন্যাল বাতি স্থাপিত হয় ১৯৮৯ সালে। যানজট নিরসনে (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগকে ২০০১-০২ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট’ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ২৫ কোটি টাকা দেয়া হলেও সে আওতায় নেই সিএমপি। বাজেটের অভাবে থমকে আছে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ- এমনটাই দাবি করছে কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে বছরের পর বছর অকেজো দাঁড়িয়ে আছে ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি। চসিকের বিদ্যুৎ বিভাগ দায় এড়িয়ে একবার দোষ দিচ্ছেন ট্রাফিক বিভাগের, আরেকবার দেখিয়ে দিচ্ছেন স্বয়ং মেয়রকে।