৪৩ দেশে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ থেকে নীতি সুরক্ষা প্রচেষ্টার অবনতি
স্টপ ও জিজিটিসি কর্তৃক ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক ২০২৩’ প্রতিবেদন প্রকাশ
বিশ্বের ৯০টি দেশের তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক প্রকাশ করেছে স্টপ ও গ্লোবাল সেন্টার ফর গুড গভার্নেন্স ইন টোব্যাকো কন্ট্রোল (জিজিটিসি)। এই সূচকে তামাক কোম্পানিগুলোর কূটকৌশল উন্মোচন করা হয়েছে যার মধ্যে অন্যতম: ইলেট্রনিক পণ্য (ই-সিগারেট, ভেপ, এইচটিটিপি ইত্যাদি) প্রচারণা ও তামাকের কারণে সৃষ্ট পরিবেশগত ক্ষতি লুকানো।
বৈশ্বিক তামাক হস্তক্ষেপ সূচক ২০২৩ এ বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সরকার অব্যাহতভাবে শক্তিশালী তামাক কোম্পানির প্রভাবের সম্মুখীন যা তামাক ব্যবহার সীমিতকরণ প্রচেষ্টা ব্যহত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশ্বিক চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (ডব্লিউএইচও এফসিটিসি) এর আর্টিকেল ৫.৩ অনুযায়ী তামাক শিল্প হতে নীতি সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে তারা যথেষ্ট ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে।
বৈশ্বিক তামাক হস্তক্ষেপ সূচক ২০২৩ নতুন প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সালের প্রতিবেদনে স্থান পাওয়া ৮০ দেশের অর্ধেকের বেশির (৪৩) স্কোরে অবনতি ঘটেছে, আর স্কোরে উন্নতি হয়েছে ২৯ টি দেশের। নিজ স্বার্থে নীতি ও নীতি প্রণেতাদের কাজে লাগানোর তামাক শিল্পের তীব্র প্রচেষ্টা থেকে কোন দেশই বাদ যায় নি, আর এসব কৌশলের মধ্যে রয়েছে ইলেক্ট্রনিক পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা তৈরিতে আগ্রাসী লবিং এবং সিগারেট ও ইলেক্ট্রনিক পণ্য উভয়ের দ্বারা সৃষ্ট পরিবেশগত ক্ষতি ঢাকার প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়;
– ব্রুনেই দারুসসালাম, নিউজিল্যান্ড, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড ও বতসোয়ানা সব মিলিয়ে সবার শীর্ষে অবস্থান করছে।
– সবচেয়ে খারাপ স্কোর পাওয়া দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ডোমিনিকান রিপাবলিক, সুইজারল্যান্ড, জাপান ও ইন্দোনেশিয়া-এদের মধ্যে প্রত্যেকটিতে তামাক শিল্পের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রয়েছে।
– সবচেয়ে চমকদপ্রদ স্কোর এসেছে ইউক্রেন, বতসোয়ানা, বুরকিনা ফাসো এবং ইথিওপিয়ার। যেহেতু তামাক কোম্পানি ক্রমাগতভাবে আফ্রিকায় ক্রেতা বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করছে, ওই অঞ্চলজুড়ে সুরক্ষা নীতিতে অগ্রসর হওয়া জরুরি হয়ে উঠেছে।
– প্রত্যেক অঞ্চলে সবচেয়ে ভাল ও সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকা সরকারের স্কোরে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছে।
– আর্জেন্টিনা ও যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসি অনুমোদন না করা দেশগুলোতে তামাক শিল্পের ব্যাপক হস্তক্ষেপ দেখা গেছে।
গ্লোবাল সেন্টার ফর গুড গভার্নেন্স ইন টোব্যাকো কন্ট্রোল এর বৈশ্বিক গবেষণা ও এডভোকেসি প্রধান, স্টপের অন্যতম অংশীদার এবং এই সূচকের শীর্ষ প্রণেতা মেরি আসুন্তা, পিএইচডি বলেন, “তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টার সবচেয়ে বড় অন্তরায় খোদ তামাক কোম্পানি। এই প্রতিবেদন বলছে যে, আত্মতুষ্টির কোন স্থান নেই। তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ থামানোর মূল চাবিকাঠি সরকারের হাতে। তাদের অবশ্যই আর্টিকেল ৫.৩ এর সদ্ব্যবহার করতে হবে। যা প্রতি বছর ৮০ লাখ তামাক সৃষ্ট মৃত্যু প্রতিরোধের ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণে তাদের উজ্জীবিত করবে।”
উল্লেখযোগ্য প্রবণতার মধ্যে আছে নতুন আসক্তকারী বস্তু যেমন: ই-সিগারেট, উত্তপ্ত তামাক পণ্য (এইচটিপি) ও নিকোটিন থলির গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে তামাক শিল্পের আগ্রাসী উদ্যোগ।
– মিসর, কেনিয়া ও উরুগুয়েতে ই-সিগারেট, উত্তপ্ত তামাক পণ্য (এইচটিপি) এবং/অথবা নিকোটিনের থলির ওপর নিষেধাজ্ঞা বাতিলে তামাক কোম্পানিগুলো সফলতার সাথে লবিং করেছে। উরগুয়েতে জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তামাক শিল্পবান্ধব ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনালের তথ্য ব্যবহার করেছে নিজেদের বিশেষজ্ঞদের মতামতের স্থলে।
– মালয়েশিয়ায় নীতিনির্ধারকেরা জাতীয় বিষাক্তপণ্য আইনের বিষাক্তপণ্যের তালিকা হতে ই-সিগারেটের নাম বাদ দিয়েছে আইনটি সংশোধনে জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল দাবি জানানোর পর।
– ইতালিতে ই-সিগেরেট ও এইচটিপি সংক্রান্ত কঠোর নিয়ন্ত্রণ বিধি আরোপের প্রস্তাব ই-সিগারেট কোম্পানি হতে অর্থসাহায্য নেয়া নীতিপ্রণেতারা সফলভাবে বাঁধা প্রদান করে।
– ফিলিপাইন তামাক শিল্পবান্ধব ই-সিগারেট আইন অনুমোদন করেছে।
ই-সিগারেট বর্জ্য নিয়ে বাড়তে থাকা উৎকণ্ঠা ও সিগারেট ফিল্টার বিষাক্ত, একবার মাত্র ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক হিসেবে নিষিদ্ধ হওয়ার দাবির মুখেই তামাক শিল্প তার পরিবেশের ওপর করা ক্ষতি ঢাকতে তোড়জোর বাড়িয়েছে।
– ব্রাজিল,কলম্বিয়া, কোস্টারিকা, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, ও উরুগুয়েসহ অন্তত ১৫ টি দেশে তামাক শিল্প পরিচালিত সিগারেট অবশিষ্টাংশ পরিচ্ছন্নকরণ কর্মসূচি সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের সমর্থন পেয়েছে।
– কোস্টারিকাতে পিএমাই পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত একটি উদ্যোগ ও আইনসভায় সিগারেটের অবশিষ্টাংশ বিশেষ বর্জ্য হিসেবে ঘোষণা দেয়া ও তার অপসারণের দায় উৎপাদনকারী বা আমদানীকারকের ঘাড়ে দেয়া বিষয়ক একটা বিল নিয়ে বিতর্ক চলছিল সমসাময়িকভাবে,
– বাংলাদেশ,বসনিয়া ও হারজেগোভিনা,ভারত, ইন্দোনেশিয়া, জ্যামাইকা, জর্ডান, মাদাগাস্কার, শ্রীলঙ্কা ও জাম্বিয়াসহ ১০টি দেশের স্থানীয় বা জাতীয় সরকার তামাক শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে অংশীদার হয়েছে নতুবা সমর্থন দিয়েছে।
জাতীয় নীতিপ্রণয়ন ছাড়াও তামাক শিল্প বৈশ্বিক চুক্তি আলোচনা লক্ষ্যবস্ত্যু বানিয়েছে, বিশেষ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) ৯ম অংশীজন সম্মেলন (কপ)।
“নীতি নির্ধারকদের মন ভোলাতে দেয়া তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কর্মসূচির অর্থ সাহায্য তাদের দ্বারা সাধিত ক্ষতি, সরকারের হারানো কর রাজস্ব ও তাদের অর্জিত কোটি কোটি টাকা মুনাফার তুলনায় নগণ্যই বটে“, এভাবেই উপসংহার টানেন আসুন্তা। তামাক শিল্পের ধোঁকাতে পড়া থেকে সরকারের বিরত থাকতে হবে, বরং তাদের কৈফিয়ত প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।”