অর্থ ও বাণিজ্যচট্টগ্রাম
চসিকের ২০ ঘাটে খাস কালেকশন, কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারানোর শঙ্কা
নিজস্ব প্রতিবেদক
চট্টগ্রাম কর্ণফুলীর সল্টগোলা-ডাঙারচর ঘাটসহ ২০টি নদী পারাপার ঘাট ইজারা না হওয়ায় নামেমাত্র খাস কালেকশন আদায়ের অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে।
এতে চসিক রাজস্ব শাখার কর্মকর্তারা স্থানীয় পর্যায়ের পুরোনো ইজারাদারদের সাথে আঁতাত করে খাস আদায়ে উঠেপড়ে লেগেছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার চসিক মেয়রের নাম ভাঙাচ্ছেন বলেও শোনা যায়।
সরেজমিনে দেখা মিলে, চসিকের এসব ঘাট দিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ যাত্রীসহ পণ্য আনা নেওয়া করা হয়। ঘাটগুলো নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা থাকায় এই পহেলা বৈশাখে ২০ ঘাটের ইজারা দেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে চসিকের রাজস্ব শাখা ‘খাস কালেকশন’ আদায়ের দিকে হাঁটছে।
এমন সুযোগে এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তারা সরকারি অর্থ ইজারা লোভী সিন্ডিকেটকে সহায়তা করে খাস রাজস্ব আদায় কম দেখানোর সুযোগ তৈরি করছেন। যা রাজস্ব ফাঁকির কৌশল ছাড়া কিছু নয় বলে পাটনিজীবি একাধিক সমিতির দাবি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুজন পুরোনো ইজারা ব্যবসায়ীরা বলেন, খাস কালেকশনে টাকা আদায় কম দেখানো হলে পরবর্তী বছরের ইজারা মূল্য কমানোর আইনগত পথ সৃষ্টি হয়।
এছাড়াও একাধিকবার খাস কালেকশনে পরের বছর আইনগত ঝামেলা এড়িয়ে কম টাকায় ইজারা নিতে পারেন ব্যবসায়ীরা। এভাবেই কিছু অসৎ কর্মকর্তার কারসাজিতে কয়েক বছর পরপর গুরুত্বপূর্ণ ঘাটগুলোর ইজারা মূল্য কমে যায় এবং সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়।
এমনকি এ পদ্ধতিতে সরকারি কোষাগারে নামমাত্র খাস জমা হলেও সিংহভাগই চলে যাবে চসিক সিন্ডিকেটের পকেটে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে এ বছরে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হবে চসিক কিংবা সরকার।
তথ্য সুত্রে জানা যায়, হাইকোর্ট বিভাগের রিট (১৫১৬৩/২৩) পিটিশনের কারণে এবার বাংলা ১৪৩১ সনে চসিক নিয়ন্ত্রণাধীন ঘাটসমূহ ইজারা স্থগিত রয়েছে। ঘাটে ঘাটে আবার কানাঘুষাও চলছে এসব চসিকেরই কৌশল। যাতে কপাল খুলে একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা ও চসিক কেন্দ্রীক সিণ্ডিকেটদের।
জানা যায়, চসিকের নিয়ন্ত্রণাধীন ঘাটসমূহ হলো-পতেঙ্গা ১৫ নং ঘাট, সল্টগোলা ঘাট, বাংলাবাজার ঘাট, নয়ারাস্তা পাকা পুলঘাট, সদরঘাট, ফিশারীঘাট, নতুনঘাট, এয়াকুব নগর লইট্যা ঘাট, পতেঙ্গা ১৪ নং ঘাট ও গুচ্ছগ্রাম ঘাট, ১১ নং মাতব্বর ঘাট, ১২ নং তিনটিংগা ঘাট, ৭নং রুবি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি সংলগ্ন ঘাট, ৯ নং বি ও সি ঘাট, অভয়মিত্র ঘাট, চাক্তাই খালের পাশে পান ঘাট হতে গাইজ্জের ঘাট, পতেঙ্গা চাইনিজ ঘাট, বাকলিয়া ক্ষেতচর ঘাট, চাক্তাই ঘাট চাক্তাই লবণঘাট।
এ বছর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ঘাটের সম্ভাব্য ইজারা মূল্য ছিল পতেঙ্গা ১৫ নং ঘাট ২ কোটি ৬৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা, সল্টগোলা ঘাট ৫৭ লাখ ৩২ হাজার ১০০ টাকা, বাংলাবাজার ঘাট ২৪ লাখ ৪ হাজার ৬০০ টাকা, সদরঘাট ২১ লাখ ৯৭ হাজার ১২৪ টাকা,
ফিশারিঘাট ২৪ লাখ ১৭ হাজার ৬৭ টাকা, পতেঙ্গা ১৪ নং ঘাট ও গুচ্ছগ্রাম ঘাট ৪২ লাখ ১৮ হাজার ৫০০ টাকা, ১১ নং মাতব্বর ঘাট ৮৭ লাখ ৩২ হাজার ৪০০ টাকা, ৯ নং বি ও সি ঘাট ৩৫ লাখ ৪২ হাজার ৫০০ টাকা।
হিসাব করলে দেখা যায়, পতেঙ্গা ১৫নং ঘাটের সম্ভাব্য ইজারা মূল্যের সাথে ২০ ভাগ ভ্যাট যোগ করলে মোট ইজারা দাঁড়ায় ৩ কোটি ২৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এতে দৈনিক কিস্তি পড়ে ৮৮ হাজার ৬০২ টাকা। অনুরূপভাবে সল্টগোলা ঘাটের দৈনিক কিস্তি ১৮ হাজার ৮৪৫ টাকা। এভাবে প্রতিটি ঘাটে দৈনিক ইজারা আদায় পড়ে ১০ হাজার থেকে ৮৮ হাজার টাকার মতো ইজারা আদায় হওয়ার কথা। কিন্তু অতি কৌশলে চসিকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মাত্র দৈনিক ২ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকার নামেমাত্র মূল্যে খাস কালেকশন আদায়ের প্রক্রিয়া নিচ্ছে চসিক।
এতে অভয়মিত্র ঘাটের খাস কালেকশনকারী মো. আবুল জানান, দৈনিক ২ হাজার টাকা মজুরীতে তিনি অভয়মিত্র ঘাট নিয়েছেন। বাংলাবাজার ঘাটের লোকমান দয়াল বলেন, দৈনিক সাড়ে ৫ হাজার টাকায় তিনি বাংলাবাজার ঘাট দেখাশোনা করছেন।
যদিও চসিক নীতিমালা অনুযায়ী ঘাট ইজারা কিংবা খাস আদায়ে সমবায় অধিদপ্তর কতৃক নিবন্ধিত স্থানীয় পাঠনীজীবি সমিতি কে ঘাট পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু খাস আদায়ের জন্য স্থানীয় পাঠনীজীবিগুলো মেয়রের কাছে ধর্না দিয়েও সাড়া না পাওয়ায় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন কিংবা মানববন্ধন করার চিন্তা ভাবনা করছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানায়।
সল্টগোলা ডাঙ্গারচর পাটনীজীবি সমবায় সমিতির সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সাম্পান মাঝিরা সাম্পান চালিয়ে বউ বাচ্চা নিয়ে দুমুঠো ডাল-ভাত খেতে চাই। আমরা চাই কেউ আমাদের পেটে লাঁথি না বসায়। টোল কিংবা খাস কালেকশন যে আদায় করবে করুক, আমরা এই ঘাটের মাঝি, আমরা যাত্রী পারাপার করতে চাই। কিন্তু বাহিরের কিছু লোকজন ঘাট দখলের পাঁয়তারা করতেছে। ঘাটে চাঁদাবাজি করার জন্য। আমরা এসব হতে দেব না।’
বেশিভাগ ঘাটের ইজারাদার জুৱধার আব্দুল শুক্কুর প্রকাশ তেল শুক্কুর বলেন, ‘আমরা কয়েকটি ঘাটের খাস কালেকশন করতেছি। প্রতি ১৫ দিন পর পর সিটি কর্পোরেশনে টাকা দিতে হয়।’
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এর আইন কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘হাইকোর্টে রিট করার কারণে ইজারা টেন্ডার বন্ধ রয়েছে। আমরা ডকুমেন্টস সংগ্রহ করতেছি। শিগগিরই রিট শুনানি করে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
চসিকের রাজস্ব কর্মকর্তা সাব্বির রাহমান সানি বিশেষ ট্রেনিং এ থাকায় কোন মন্তব্য করতে পারেননি। তবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সহকারী এস্টেট অফিসার আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমাদের আইন শাখা কাজ করতেছে। শিগগিরই হাইকোর্টের স্টে-অর্ডারটি ব্যাকেট করা হবে। তারপর ঘাটগুলোর টেন্ডার কল করা হবে।’
চসিক প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা (সিআরও) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম জানান, গতকাল খাস কালেকশনে হাটবাজারের নতুন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এভাবে খাস খালেকশন চলতে থাকলে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আসবে না। সেটাও সত্য।’