বিশেষ খবররাজনীতি

হাইকোর্ট রায়ের অনুলিপি পেলে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা অনুসারে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে: এটর্নি জেনারেল

 

ঢাকা, ১ জুলাই, ২০২৪ (বাসস):  দেশের ইতিহাসে বহুল আলোচিত চাঞ্চল্যকর হলি আর্টিজান জঙ্গি হামলায়
হত্যাকান্ডের ঘটনায় আনা মামলা বিষয়ে এটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে তা পর্যালোচনার পর রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তাদের নির্দেশনা অনুসারে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। এটর্নি জেনারেল বলেন, হাইকোর্ট রায়ের অনুলিপি পেলে বুঝতে পারব কী যুক্তিতে বা কোন কোন যুক্তিতে আসামিদের মৃত্যুদন্ড থেকে আমৃত্যু কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো রায়ের কপি আমরা পাইনি।
এটর্নি জেনারেল বলেন, মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে হাইকোর্ট আসামিদের আমৃত্যু কারাদন্ড দিয়েছেন। তাই তাদের মৃত্যু পর্যন্ত কারাগারেই থাকতে হবে। কারাগার থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই।
রাজধানীর হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিদের সশস্ত্র হামলায় নৃশংস হত্যাকান্ডের মামলায় হাইকোর্টের রায় প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। গত বছরের ৩০ অক্টোবর এই মামলার হাইকোর্ট রায় দেয়। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, হলি আর্টিজান হামলায় দেশি-বিদেশি ২০ জন নাগরিকসহ দু’জন পুলিশ কর্মকর্তাকে নিষ্ঠুর ও নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাতে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করেছে হাইকোর্ট। রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে আলোচিত সন্ত্রাসী হামলা মামলায় বিচারিক আদালতের দেয়া মৃত্যুদন্ডাদেশ কমিয়ে ৭ আসামীর আমৃত্যু কারাদন্ডাদেশের রায়ে এই মন্তব্য করেছেন উচ্চ আদালত।
রায়ে আদালত বলেন, নিষ্ঠুরতম হত্যাকান্ডটি জনসাধারণের মনে চরম আতঙ্ক সৃষ্টিসহ জননিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করেছে। বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত একটি হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ আসামিদের আপিল ও জেল আপিল এবং ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদন্ডাদেশ অনুমোদন) খারিজ করে রায় দেয়। আদালত রায়টি বাংলায় ঘোষণা করেন। রায়ে আদালত বলেন, সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এর ধারা ৬ (১) (ক) (আ) ধারার অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আপিলকারী ১. মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, ২. মো. আসলাম হোসেন সরদার ওরফে মোহন, ৩. মো. আব্দুস সবুর খান (হাসান), ৪. রাকিবুল হাসান রিগেন ওরফে রাফিউল ইসলাম, ৫. মো. হাদিসুর রহমান, ৬. মো. শরিফুল ইসলাম খালেদ এবং ৭. মামুনুর রশিদ রিপনকে আইনের ৬(২)(আ) ধারায় বর্ণিত সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হলো। মামলায় দেশি-বিদেশি ২০ জন নাগরিকসহ দুই জন পুলিশ কর্মকর্তাকে যে নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, তাতে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়া এই নিষ্ঠুরতম হত্যাকান্ডটি জনসাধারণের মনে চরম আতঙ্ক সৃষ্টিসহ জননিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করেছে। রায়ে বলা হয়, এই অবস্থায় আপিল বিভাগের ‘আতাউর মৃধা ওরফে আতাউর বনাম রাষ্ট্র’ মামলার নজিরের ১৭৯ প্যারায় বর্ণিত পর্যবেক্ষণের মর্ম অনুসারে আপিলকারীদেরকে আমৃত্যু কারাদন্ডে দন্ডিত করা হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। সে অনুযায়ী প্রত্যেককে আমৃত্যু কারাদন্ডে দন্ডিত করা হলো। তাদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ড অনাদায়ে ৫ বৎসরের কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়- বলে রায়ে উল্লেখ করেন হাইকোর্ট।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ। আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী আরিফুল ইসলাম ও আমিমুল এহসান। আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ছিলেন এস এম শফিকুল ইসলাম।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯ এর ৬ (১) (ক) (অ) ধারা অনুসারে অপরাধ করায় বিচারিক আদালত তাদের মৃত্যুদ- দিয়েছেন। কিন্তু হাইকোর্ট বলেছেন-না, এই আসামিরা ৬ (১) (ক) (আ) ধারা অনুসারে অপরাধ করেছেন। অর্থাৎ এই আসামিরা কেউই সরাসরি হত্যাকান্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন না। তারা সহযোগিতার (অ্যাবেটমেন্ট) সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখানে সাজা হলো যাবজ্জীবন। এখানে আপিল বিভাগের ‘আতাউর মৃধা ওরফে আতাউর বনাম রাষ্ট্র’ মামলার নজিরের ১৭৯ প্যারায় বর্ণিত পর্যবেক্ষণের মর্ম অনুসারে আপিলকারীদের আমৃত্যু কারাদন্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলা চালিয়ে বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করেন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির (আত্মঘাতী) সদস্যরা। তাদের গুলিতে দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। পরে কমান্ডো অভিযানে নিহত হন পাঁচ জঙ্গি। এ ঘটনা দেশ বিদেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এ ঘটনার মামলায় ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান একজনকে খালাস দিয়ে সাতজনের মৃত্যুদন্ডাদেশ দেন। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র‌্যাশ, আব্দুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ। খালাস পেয়েছেন মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান।
ফৌজদারি মামলায় বিচারিক আদালত যখন আসামিদের মৃত্যুদন্ড দেন, তখন ওই দ- কার্যকরের জন্য হাইকোর্টের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা অনুযায়ী মামলার সব নথি হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেন, যা ডেথ রেফারেন্স নামে পরিচিত। নথি আসার পর হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংশ্লিষ্ট মামলার পেপারবুক প্রস্তুত করে। এরপর বেঞ্চ নির্ধারণ হলে শুনানি শুরু হয়। সে আলোকে মামলাটি হাইকোর্টে শুনানি ও রায় হয়েছে।
দেশের ইতিহাসে অন্যতম নৃশংস এ হামলায় ৯ ইতালীয়, ৭ জাপানি, এক ভারতীয়, এক বাংলাদেশি-আমেরিকান দ্বৈত নাগরিক ও দুজন বাংলাদেশিসহ মোট ২০ জনকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় সন্ত্রাসীদের ছোড়া গ্রেনেডের আঘাতে প্রাণ হারান বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিন আহমেদ ও সহকারী পুলিশ কমিশনার রবিউল ইসলাম।
হামলার পর জিম্মি অবস্থার অবসানে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে নিহত হন পাঁচ জঙ্গি। তারা হলেন- মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ওরফে মামুন, নিবরাস ইসলাম, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের সময় নিহত হয়েছেন নব্য জেএমবির আরও আট সদস্য। তাদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল হাসনাত রেজা করিমও অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান।
ওই ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গুলশান থানায় একটি মামলা করেন ওই থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রিপন কুমার দাস। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির মামলাটি তদন্ত করে ২০১৮ সালের ১ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button