চট্টগ্রামশীর্ষ নিউজ

কর্ণফুলী ওসির বিরুদ্ধে দুই লাখের চুক্তিতে আসামি ধরার অভিযোগ!

পিন্টু দাশ, নিজস্ব প্রতিবেদক

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গণহারে দায়ের করা পাঁচলাইশ মডেল থানার এক মামলায় পতেঙ্গা থেকে কর্ণফুলী পুলিশের একটি টিম আনোয়ারা উপজেলার মুজিবুর রহমান মুজিব (৪৭) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছেন। পরে পাঁচলাইশ থানা হয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠিয়েছেন বলে খবর পাওয়া যায়। বিষয়টি নিয়ে আনোয়ারা উপজেলা তথা দক্ষিণ চট্টগ্রাম জুড়ে আলোচনা-সমালোচনা বইছে। এতে নিরীহ একজন ব্যক্তিকে ফাঁসানো হয়েছে বলে অভিযোগও উঠেছে।

স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, বারশত ইউনিয়নের এক সাবেক চেয়ারম্যানের সাথে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ছিলো মুজিবের। কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (কাফকো) তে গ্রেপ্তার মুজিবের ব্যবসা ছিলো। এলাকায় সে মুজিব মেম্বার নামে পরিচিত। সে ব্যবসায় দ্বন্দ্বের জেরে একটি ব্যবসায়ি সিন্ডিকেট কর্ণফুলী পুলিশকে ব্যবহার করে পতেঙ্গা থেকে মুজিবকে গ্রেপ্তার করে পাঁচলাইশ থানায় নিয়ে যান বলে সুত্রে জানায়। শাহমীরপুর পুলিশ ফাঁড়ির আইসি এসআই আবু সাঈদ রানা এ অভিযানের নেতৃত্ব দেন। এতে গফুর ভাঙ্গারী নামক এ ব্যক্তিও জড়িত বলে কানাঘুষা রয়েছে।

এ বিষয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে গ্রেপ্তার মুজিবের ছেলে মো. সাদমান (২৬) বলেন, ‘গ্রেপ্তারের পর থানায় গিয়ে আমরা আমার আব্বুর সাথে দেখা করেছি। উনি জানালেন তাঁকে বৈরাগের ইফতিয়াল কাশেম চার্লি (৩১) নামক এক যুবক ধরিয়ে দিয়েছেন। আমার আব্বুুকে যখন কর্ণফুলী পুলিশ আটক করছেন। তখন একই বৈঠকে কাশেম চার্লিও ছিলেন।’

সাদমান আরও বলেন, ‘পাঁচলাইশের যে মামলায় বাবা গ্রেপ্তার সেই একই মামলায় চার্লিও এজাহারভূক্ত ৮ নম্বর আসামি। কিন্তু পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেনি। আমার বাবাকে গ্রেপ্তার করেছে। বাবা ঠিক ওই সময় চার্লিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে পুলিশকে বলছে একই মামলার আসামি তাকে ধরছেন না। তখন এক পুলিশ সদস্য জানায় তাকে ধরার জন্য কন্টাক হয়নি।’

বিষয়টি অর্থের বিনিময়ে হোক আর অন্য কৌশলেই হোক, প্রকৃত অপরাধীর পরিবর্তে নিরপরাধ ব্যক্তিকে যে কোন মামলায় কারাগারে পাঠানো দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার আইনজীবী আহসান। কেননা, চলমান গণহারে মামলা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এখন থেকে মামলা হলেই আর গ্রেপ্তার করা হবে না৷ আগে তদন্ত হবে, তারপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ কিন্তু সে কথাটি প্রযোজ্য হয়নি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী আনোয়ারার বৈরাগ ইউনিয়নের উত্তর বন্দর এলাকার শমসের আলীর ছেলে মুজিবুর রহমান মুজিব (৪৭) এর ক্ষেত্রে।

তথ্য বলছে, গত ৮ অক্টোবর রাতে তাঁকে পতেঙ্গা থেকে গ্রেপ্তার করেছেন সিএমপি কর্ণফুলী থানা পুলিশ। তবে বিষয়টি জানাজানি হয় অনেক পরে। এ অভিযানে কর্ণফুলী ওসি মোহাম্মদ মনির হোসেন ও সেকেন্ড অফিসার নূরে ইসলাম এর নেতৃত্বে অংশ নেন শাহমীরপুর পুলিশ ফাঁড়ির আইসি এসআই আবু সাঈদ রানা, এসআই অমিতাভ দত্ত, এসআই আবুল কালাম, এএসআই পঞ্চানন রুদ্র। পরে তাঁরা পতেঙ্গা থেকে মুজিব কে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যান পাঁচলাইশ থানায়।

বিশ্বস্ত সুত্রে জানায়, পাঁচলাইশ থানা পুলিশ এ আসামি গ্রহণ করতে চায়নি। কেননা, ২৮ সেপ্টেম্বর পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম চট্টগ্রামে এসে বলেছিলেন, ‘মামলার আসামি হলেই গ্রেপ্তার করা যাবে না। শুধু তদন্তে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলেই গ্রেপ্তার করা হবে। মামলা হলেই যে গ্রেপ্তারের আওতায় আসবে, সেটা আইন বলে না।’

পরে পাঁচলাইশ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উর্ধ্বতন কর্মকতাদের অবগত করে ১০ নম্বর এজাহার নামীয় আসামি মুজিবুল রহমান মুজিবকে (পাঁচলাইশ মডেল থানা মামলা-৩১/২৪৬) আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠান। এ মামলার বাদি বাঁশখালী উপজেলার ছাপাছড়ি গ্রামের তালুকদার বাড়ির আব্দুল কাদের এর ছেলে মোহাম্মদ রিদুওয়ান (২৮)।

এ মামলার ধারা হলো ১৪৭/ ১৪৮/ ১৪৯/ ৩২৬/ ৩০৭/ ৩৪ পেনাল কোড। হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করে গুরুতর জখম করার অপরাধ। গ্রেপ্তার মুজিবকে মামলার বাদি চিনেন কিনা তা জানার জন্য এজাহারে থাকা বাদির বাংলালিঙ্ক নম্বরে একাধিকবার কল করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।

তবে এই বিষয়ে পাঁচলাইশ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সোলাইমান বলেন, এ বিষয়ে কোন মন্তব্য নেই। কারণ আমার কোন থানা পুলিশ এ ধরনের ধরেনি।

অনুসন্ধানে তথ্য মিলে, একই থানায় গ্রেপ্তার মুজিবুর রহমান মুজিব (৪৭) এর নামে আরেকটি ককটেল বিস্ফোরণ করে মারামারির অপরাধে মামলা হয়। গত ৫ সেপ্টেম্বর মামলাটি দায়ের করেন বোয়ালখালীর ইকবাল পার্ক এলাকার জিয়াউল হক জোনাইদ (৩৩)। যার পাঁচলাইশ মডেল থানার মামলা নম্বর-১৭/২৩২। এই মামলায়ও এজাহার নামীয় ৪৩ নং আসামিও মুজিবর রহমান মুজিব (৪৭)। তবে বাদি আসামিদের চিনেন কিনা সন্দেহ।

নির্ভরযোগ্য একটি সুত্র জানায়, কাফকো থেকে মুজিবকে সরাতে গফুর কে দুই লক্ষ টাকা দেন বারশত ইউনিয়নের এক সাবেক চেয়ারম্যান। গফুরের সাথে কর্ণফুলী থানার এসআই আবু সাঈদ রানার দহরম মহরম সম্পর্ক। টানেলে ক্যাবল চুরির এক মামলার সুত্র ধরে। যা অনুসন্ধান করলে সত্যতা মিলবে।

পরে এসআই রানা থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই নূরে ইসলামকে দিয়ে ওসিকে ম্যানেজ করে কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন বলে প্রচার হচ্ছে সবদিকে। কারণ কোন ইন্টারেস্টে পাঁচলাইশ থানার এক গণহারে করা মামলায় কর্ণফুলী থানা অধিক্ষেত্রের বাহিরে, পতেঙ্গা গিয়ে নিরাপরাধ আসামি ধরার অভিযান অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। যা পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকতারা হয়তো ভালো বুঝবেন। পরে কর্ণফুলী থানার কোন পুলিশ সদস্য এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি নন।

এসআই রানাও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন। তবে এ ব্যাপারে কর্ণফুলী থানার এসআই অমিতাভ দত্ত, এসআই আবুল কালাম, এএসআই পঞ্চানন রুদ্র অনেকটা লেনদেনের অন্ধকারে ছিলেন বলে সুত্র জানায়।

পাঁচলাইশ থানার মামলা তদন্ত কর্মকর্তা এসআই রূপন চৌধুরী বলেন, ‘আমি কাউকে ৫ আগস্টের পরের মামলায় গ্রেপ্তার করিনি। যদিও মামলাটির আইও আমি। পরে জেনেছি কর্ণফুলী থানার এসআই আবু সাঈদ রানা এজাহার নামীয় আসামি মুজিবর রহমান মুজিবকে গ্রেপ্তার করে থানায় আনেন। আমি আদালতের ফরওয়ার্ডিং-এ ওনার নাম লিখে দিয়েছি। যেহেতু কর্ণফুলী থানা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছেন।’

কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মনির হোসেন এর কাছে জানতে চাওয়া হয় কর্ণফুলী থানার বাহিরে পতেঙ্গা থানা এলাকায় গিয়ে পাঁচলাইশ থানা মামলার আসামি গ্রেপ্তারে কোন রিকুইজিশন ছিলো কিনা এবং অভিযোগ আসতেছে দুই লাখ টাকার বিনিময়ে ওই আসামিকে কর্ণফুলী থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে পাঁচলাইশে নিয়ে যায় এমন প্রশ্ন করলেও কোন কথা বলতে রাজি না কর্ণফুলীর ওসি মনির।

সিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার (এডিসি) কাজী মো. তারেক আজিজ বলেন, ‘এ ধরনের কেউ অভিযোগ করেনি। তবে বিষয়টি খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে।’

প্রসঙ্গত, গত ২৮ সেপ্টেম্বর আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম চট্টগ্রামে এক বৈঠকে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যে মামলাগুলো হচ্ছে, সেগুলোতে আসামি হিসেবে অনেক সাংবাদিক যেমন আছেন, তেমনি অনেক পুলিশ সদস্যও রয়েছেন। সাংবাদিকদের চেয়ে মামলায় পুলিশের সদস্য অনেক গুণ বেশি আসামি হয়েছেন। বিজিবি, ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনারদের ও আসামি করা হয়েছে। মামলা হলেই যে গ্রেপ্তারের আওতায় আসবে, সেটা আইন বলে না।’

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button