বিনোদনবিশেষ খবর

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সেন্ট মার্টিনে পর্যটক সীমিত করার সিদ্ধান্ত

 

ঢাকা, ২২ অক্টোবর, ২০২৪ (বাসস) : পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের স্বার্থে সরকার সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটকের সংখ্যা সীমিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই চার মাস সেখানে পর্যটক সীমিত থাকবে।

আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একডেমিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উিইং আয়োজিত এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর সরকারের এ সিদ্ধান্তের কথা জানান।

তিনি জানান, নভেম্বর মাসে পর্যটকরা যেতে পারবেন, কিন্তু রাত যাপন করতে পারবেন না। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে প্রতিদিন দুই হাজারের বেশি পর্যটক সেন্ট মার্টিন যেতে পারবে না। আর ফেব্রুয়ারি মাসে সেন্ট মার্টিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজে পর্যটক যাওয়া বন্ধ রাখা হবে।

এক প্রশ্নের যেভাবে অপূর্ব জাহাঙ্গীর জানান, বছরের অন্যান্য মাসের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।মূলত এ সময়ে পর্যটকদের চাপ অনেক বেশি থাকে সেজন্য এই চার মাসের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

উপ-প্রেস সচিব বলেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে এবং এই দ্বীপের প্রবালগুলো রক্ষণাবেক্ষণ না করা হলে, পর্যটকদের অতিরিক্ত চাপে এটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, পরিবেশ রক্ষায় সরকার সেন্ট মার্টিনে একবার ব্যাবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করেছে। পরিবেশগত উদ্বেগের কারণে সরকার এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সেন্ট মার্টিন দেশের বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত এ দ্বীপটি দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। পর্যটকদের ভিড় লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকায় সেন্টমার্টিনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।

দ্বীপটিতে প্রতিদিন অনিয়ন্ত্রিত পর্যটকদের যাতায়াত, অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, পরিবেশ দূষণ, পর্যটকদের অসচেতনতা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কারণে সেখানকার ইকো-সিস্টেম অর্থাৎ প্রতিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিভিন্ন মহল থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছিল। কিন্তু দ্বীপটিকে বাঁচাতে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠছিল।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দ্বীপটির পরিবেশ ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে বলেও মনে করেন পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন।

দ্বীপটির প্রবাল, শৈবাল, সামুদ্রিক কাছিম, লাল কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুকসহ নানা জলজ প্রাণী এবং জীব-বৈচিত্র্য এখন বিলুপ্ত হবার পথে। সেন্ট মার্টিনে যেকোনো ধরনের স্থাপনা গড়ে তোলার ব্যাপারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সেগুলো উপেক্ষা করেই সেখানে একের পর এক রিসোর্ট, হোটেল, মোটেল গড়ে উঠছে।

জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিন সংলগ্ন ৫৯০ হেক্টর এলাকাকে পরিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকা- ইসিএ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে দ্বীপের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও বিরল জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারসহ দ্বীপটিকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) অনুযায়ী দ্বীপে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ১৪টি বিধিনিষেধ আরোপ করে।

এসব বিধিনিষেধের মধ্যে ছিল- দ্বীপের সৈকত, সমুদ্র বা নাফ নদীতে সব ধরণের প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা, পশ্চিম পাশের সৈকতে কোনাপাড়ার পর দক্ষিণ দিকে এবং পূর্ব পাশের সৈকতে গলাচিপার পর দক্ষিণ দিকে পরিভ্রমণ, দ্বীপে যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক বাহন চালানো, দ্বীপের চারপাশে নৌ ভ্রমণ, রাতে আলো জ্বালানো এবং ফ্ল্যাশ লাইট ব্যবহার করে ছবি তোলা, সৈকতে মাইক বাজানো, হৈ-চৈ বা উচ্চস্বরে গান বাজনা করা, বার-বি-কিউ পার্টি করা ইত্যাদি।

২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে সেন্টমার্টিন দ্বীপ সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গ কিমি এলাকাকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়।

এ ঘোষণার ফলে এখন থেকে এ দ্বীপে অনিয়ন্ত্রিত জাহাজ ও মোটর বোট চলাচল নিষিদ্ধ। এছাড়া দ্বীপ সংলগ্ন এলাকায় অতিরিক্ত মাছ ধরা, সাগরে বর্জ্য ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ফেলা, প্রবাল প্রাচীর ধ্বংস, জীববৈচিত্র্য নষ্ট করা যাবে না।

বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ অনুযায়ী এ ঘোষণা দেওয়া হয়। এটি এখন পর্যন্ত দেশের বৃহত্তম সংরক্ষিত এলাকা এবং দ্বিতীয় সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা।
সেন্টমার্টিনকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণার ফলে বিপন্ন পিঙ্ক ডলফিন, হাঙ্গর, রে মাছ, সামুদ্রিক কচ্ছপ, সামুদ্রিক পাখি, প্রবাল, সামুদ্রিক ঘাস এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য এবং তাদের আবাসস্থল সংরক্ষণে সহায়তা করবে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।

পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে থাকা এই দ্বীপটির স্থায়ী বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার। এছাড়া পর্যটক মিলে প্রতিদিন দ্বিগুণ সংখ্যক মানুষের চাপ নিয়ে এক প্রকার মৃতপ্রায় অবস্থা সেন্টমার্টিনের।

অতিদ্রুত পর্যটকদের স্রোত ঠেকানো না গেলে এই দ্বীপের পরিবেশে ভারসাম্য ফেরানো রীতিমত অসম্ভব হবে বলে মনে করেন পরিবেশবাদীরা। সেন্টমার্টিনের জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে দ্বীপটি যে কোন সময়ে সমুদ্রে বিলীন হয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তারা।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ২৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪ প্রজাতির উভচর ও ১২০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়।
এছাড়া রয়েছে ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে স্পঞ্জ, শিল কাঁকড়া, সন্ন্যাসী শিল কাঁকড়া, লবস্টার ইত্যাদি। মাছের মধ্যে রয়েছে পরী মাছ, প্রজাপতি মাছ, বোল করাল, রাঙ্গা কই, সুঁই মাছ, লাল মাছ, উড়ুক্কু মাছ ইত্যাদি।

সেন্ট মার্টিন অঞ্চল সামুদ্রিক কচ্ছপ সবুজ সাগর কাছিম এবং জলপাইরঙা সাগর কাছিম প্রজাতির ডিম পাড়ার স্থান হিসেবেও খ্যাত।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button