কর্ণফুলীতে প্যানেল চেয়ারম্যানদেরও বাদ দিয়ে ইউএনও-এসিল্যান্ড কেন?
নিজস্ব প্রতিবেদক
কর্ণফুলীতে সকল চেয়ারম্যানদের অনুপস্থিত দেখিয়ে ইউএনও ও এসিল্যান্ডের ক্ষমতা গ্রহণ একটি প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত বলে নানা অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
কর্ণফুলীর পাঁচ ইউনিয়নে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বিপরীতে নতুন ভাবে চলা কার্যক্রমের বৈধতা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, অধিকাংশ চেয়ারম্যান এবং প্যানেল চেয়ারম্যানদের উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও গত ১৯ সেপ্টেম্বর তাঁদের অনুপস্থিত দেখিয়ে ইউএনও ও এসিল্যাণ্ড আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। এ ধরনের পদক্ষেপ শুধুমাত্র স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নীতিমালার পরিপন্থি নয়, বরং এটি জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকাকে উপেক্ষা করার একটি দৃষ্টান্ত বলে মনে করছেন ৬০ জনেরও অধিক কর্ণফুলীর জনপ্রতিনিধিরা।
জানা গেছে, স্থানীয় সরকার আইন, ২০০৯-এর ধারা অনুযায়ী, চেয়ারম্যান এবং প্যানেল চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতি নিশ্চিত হলে কেবল ইউএনও বা এসিল্যান্ডকে প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ করা যায়। কিন্তু কর্ণফুলীর ঘটনাপ্রবাহে দেখা যায়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা তাদের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকলেও, তাদের অনুপস্থিত দেখিয়ে প্রশাসনিক ক্ষমতা ইউএনও এবং এসিল্যাণ্ডের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
এতে চেয়ারম্যান হাজী ছাবের আহমদ এবং মোহাম্মদ দিদারুল আলম, জাহাঙ্গীর আলম চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কে লিখিতভাবে অভিযোগে জানান, তারা নিয়মিত উপস্থিত থেকে পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। পাশাপাশি, প্যানেল চেয়ারম্যানদের অনুপস্থিত দেখানোর অভিযোগকেও তারা মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যমূলক বলে দাবি করেছেন।
এতে ইউএনও-এসিল্যাণ্ডেরর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ ও অসঙ্গতিপূর্ণ বলে ধারণা জম্মেছে।
চেয়ারম্যানদের অনুপস্থিত দেখানোর যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে, তা শুধু নীতিমালা লঙ্ঘন নয়, বরং এটি স্থানীয় সরকারের স্বায়ত্তশাসনের পরিপন্থি। ইউএনও এবং এসিল্যাণ্ডের এই পদক্ষেপে মনে হয়, তারা জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা খর্ব করার একটি সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করেছেন।
জনপ্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের হাতে দায়িত্ব অর্পণ করার ফলে নাগরিক সেবায় বিঘ্ন ঘটছে বলে সোচ্চার জনগণ।
জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনসহ স্থানীয় পরিষদের নানা কার্যক্রমে সমস্যা তৈরি হয়েছে। প্যানেল চেয়ারম্যান আয়েশা আক্তারের বক্তব্য অনুযায়ী, তিনি উপস্থিত থেকেও তার অনুপস্থিতি দেখানো হয়েছে। এটি দায়িত্বশীল প্রশাসনের প্রতি আস্থা ক্ষুণ্ণ করার মতো ঘটনা। জেলা প্রশাসকের কাছে দেওয়া প্রতিবেদন স্থানীয় প্রশাসনের ব্যাখ্যায় যথেষ্ট নয় বলেও দাবি তাদের।
ইউনিয়ন পরিষদের স্থানে উপজেলা কর্মকর্তাদের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, যা জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধক আইন ২০০৪-এর ৪(১)(ছ) ধারার পরিপন্থি।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ এডভোকেট আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এটি সাময়িক পদক্ষেপ। কিন্তু এই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ ইউনিয়ন পরিষদে জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি নিশ্চিত করার কোনো নিরপেক্ষ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। প্যানেল চেয়ারম্যান পদের নারী জনপ্রতিনিধিরাও কি ৫ আগস্টের পর কর্ণফুলী থেকে পালিয়ে গেছেন। বরং এটি যেন একটি পূর্বপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত, যা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ভিত্তিকে দুর্বল করেছে।’
স্থানীয়রা বলেছেন, এই পদক্ষেপে কর্ণফুলীর পাঁচ ইউনিয়নবাসীর ভোগান্তি বেড়েছে। নাগরিক সেবা যেমন জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন, এবং দৈনন্দিন পরিষেবা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মর্যাদা এবং কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
ইউএনও এবং এসিল্যাণ্ডের এই সিদ্ধান্তের পেছনে সঠিক উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। স্থানীয় সরকারের নিয়ম মেনে চলার পাশাপাশি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করাই প্রশাসনের মূল দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা এবং তাদের বৈধ উপস্থিতি যাচাইয়ের প্রয়োজন ছিল আরো বেশি। কিন্তু তড়িগড়ি করে নিজেরাই ইউনিয়নের দায়িত্ব নিতে জেলা প্রশাসনে অসত্য প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন বলেও মন্তব্য অনেকের।
এ ধরনের সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা খর্ব করে না, বরং স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট করে। প্রয়োজনীয় নীতিমালা অনুসরণ না করে ইউএনও ও এসিল্যাণ্ডের ক্ষমতা গ্রহণ একটি ভুল সিদ্ধান্ত, যা দ্রুত পুনর্বিবেচনা করা উচিত। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং জেলা প্রশাসনের উচিত এই পরিস্থিতির নিরপেক্ষ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ও ইউপি প্রশাসক মাসুমা জান্নাত জানান, ‘নাগরিক সেবা সচল করার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগ যে সিদ্ধান্ত দেন তা আমরা শুধু মাঠে বাস্তবায়ন করি।’
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উপ-পরিচালক মো. নোমান হোসেন বলেন, ‘এলাকায় থাকা মানে পরিষদে থাকা নয়। পরিষদে থেকে নিয়মিত সেবা দিতে পারলে ও সরকারি নির্দেশনা আসলে চেয়ারম্যানদের প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা ফেরত প্রদান করা হবে। সাময়িক ভাবে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা আসলে এটি যেকোন সময় পরিবর্তন হবে। আর কর্ণফুলীর বিষয়ে আমরা খোঁজ খবর নিচ্ছি।”
কর্ণফুলীর ১৪ নারী জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, কর্ণফুলীতে চেয়ারম্যান এবং প্যানেল চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে ইউএনও এবং এসিল্যাণ্ডকে ক্ষমতা প্রদান নিয়ে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার উপর একটি বড় প্রশ্ন উঠেছে।
তৃণমূল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়া জনসেবায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টির সমাধানে সবার সহযোগিতা ও স্বচ্ছ তদন্ত প্রয়োজন।