চট্টগ্রামশীর্ষ নিউজ

কর্ণফুলীতে কষ্টি পাথরের মূর্তি-তান্ত্রিক কিতাব উদ্ধারের দাবি! অনুসন্ধানে ষড়যন্ত্রের আভাস

নিজস্ব প্রতিবেদক
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলায় শতবর্ষ পুরোনো কষ্টি পাথরের মূর্তি, খোদাই করা স্বর্ণ রঙের আসন, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় লেখা তান্ত্রিক কিতাব, প্রাচীন নকশা ও ৫৭০টি অদ্ভুত আকৃতির ছবি উদ্ধারের দাবি ঘিরে রহস্য তৈরি হয়েছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে লিখিতভাবে বিষয়টি জানানোর পর এটি নিয়ে শুরু হয়েছে নানা বিতর্ক আর অনুসন্ধান।
অভিযোগপত্রে মোহাম্মদ আলী হোসেন উল্লেখ করেছেন, ২০১৯ সালের ৫ জানুয়ারি গভীর রাতে তিনি তার দুই বন্ধুর সঙ্গে এসব প্রত্নসম্পদ উদ্ধার করেন। তাদের দাবি, ৬ বছর আগে এগুলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ, তাই সরকারকে হস্তান্তর করতে চেয়েছিলেন। তবে কর্ণফুলীর এজাজুর রহমান ও মো. মনির ঘটনাস্থলে এসে জোরপূর্বক এসব নিদর্শন নিয়ে যান বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
তবে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভিন্ন চিত্র। স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে এ ধরনের কোনো ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি। কর্ণফুলী উপজেলার খোয়াজনগর গ্রামের শুক্কুর চেয়ারম্যান বাড়ির আশপাশের এলাকাবাসী জানিয়েছেন, তারা এমন কোনো ঘটনা সম্পর্কে কখনো শোনেননি বা দেখেননি।
অভিযোগকারীর ভাষ্য অনুযায়ী তিন বন্ধু এই প্রত্নসম্পদ উদ্ধার করলেও সাক্ষী হিসেবে কেবল শহিদুল ইসলাম ও মনির আহমদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অভিযোগে দেওয়া ফোন নম্বরটিও শহিদুল ইসলামের, যিনি নিজেকে আলী হোসেনের বন্ধু বলে দাবি করেন। কিন্তু যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, এত মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন কীভাবে ও কোথায় পাওয়া গেছে, তখন তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান এবং দাবি করেন, এক “সাংবাদিক” এসব জানেন।
পুনরায় জিজ্ঞাসা করা হলে শহিদুল ইসলাম জানান, ঘটনার রাতে তারা শুক্কুর চেয়ারম্যান বাড়ির মিনুর বাড়িতে গিয়েছিলেন এক ব্যক্তির কাছে পাওনা টাকা আনতে। তখনই ওই বাড়ির দ্বিতীয় তলার একটি ভাড়া বাসা থেকে এসব সামগ্রী পান বলে দাবি করেন। কিন্তু সেটি কার বাসা ছিল, কীভাবে তারা সেগুলো পেলেন এবং এতদিন এগুলো কোথায় রাখা হয়েছিল—এসব বিষয়ে তিনি কোনো স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেননি।
অন্যদিকে, অভিযোগকারী মোহাম্মদ আলী হোসেন যখন বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন, তখন তিনি রাকিব আল হোসেন শিমুল নামের একজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাকিব আল হোসেন শিমুল কর্ণফুলী থানার জিআর ০৯/৩০৪ ডাকাতি মামলার ৬ নম্বর এজাহারভুক্ত আসামি, যিনি ২০২৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের খোয়াজনগর আলত্বাফিয়া ইয়াছিনিয়া আল এজাজ ইন্টারন্যাশনাল হেফজ ও এতিমখানায় ডাকাতি করতে গিয়ে জনতার হাতে ধরা পড়েছিলেন।
যদিও অভিযোগে যাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে, তাদের অন্যতম ব্যক্তি এজাজুর রহমান এই ঘটনাকে ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘এটি আমাদের পারিবারিক ও মাদ্রাসার সম্মানহানির অপচেষ্টা। যদি তারা সত্যিই এসব নিদর্শন উদ্ধার করে থাকেন, তাহলে কোনো স্বাক্ষী বা প্রমাণ থাকতো। এটি পুরোপুরি হয়রানিমূলক মামলা।’
এজাজুর রহমান আরও জানান, ‘কিছুদিন আগে রাত ১১টা ৪২ মিনিটের দিকে পুলিশ তাদের মাদ্রাসার গেটে এসে তদন্তের কথা বলেছিলো, কিন্তু নিরাপত্তার কারণে গেট খোলা হয়নি। কারণ এর আগেও গোয়েন্দা পরিচয়ে একটি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছিলো সেখানে। তিনি মনে করেন, পারিবারিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নষ্ট করতেই এই ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।
অন্যদিকে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও অভিযোগের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। খোয়াজনগর এলাকার ইউপি সদস্য মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এ ধরনের কোনো ঘটনা সম্পর্কে আমি জানি না। তবে মাসখানেক আগে এবং গত শুক্রবার আলী হোসেন নামে এক ব্যক্তি আমাকে বিষয়টি জানান। এর বাইরে আমি কিছু জানি না।’
সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য নুরতাজ বেগমও বলেন, ‘গত ছয় বছরে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। আমি কখনো এ ধরনের কোনো ঘটনার সাক্ষী ছিলাম না।’
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্ণফুলী থানার ওসিকে বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কর্ণফুলী থানার ওসি মুহাম্মদ শরীফ জানিয়েছেন, ঘটনাটি এখনো তদন্তাধীন এবং মূল অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি।
তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সুজন দাশ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত অভিযোগের সত্যতা মেলেনি। যথাযথ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলা যাবে।’
চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আলহাজ্ব এম মঈন উদ্দিন বলেন,
‘এই ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য প্রশাসনের তদন্ত প্রয়োজন কার বাসায় এসব পেয়েছে। আদৌও সত্য কিনা। প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, ৬ বছর আগের উদ্ধার হওয়া প্রত্নসম্পদ এতদিন কোথায় ছিল। কেন এতদিন পরে অভিযোগ করা হলো। অভিযোগের সঙ্গে থাকা স্বাক্ষীদের বক্তব্য অসঙ্গতিপূর্ণ কেন। যদি সত্যিই মূল্যবান প্রত্নতত্ত্ব উদ্ধার করা হয়ে থাকে, তাহলে তা সংরক্ষণের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন। তদন্ত ছাড়া এসব প্রশ্নের সুস্পষ্ট উত্তর মিলবে না, ফলে প্রশাসনের উচিত বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে পর্যবেক্ষণ করা।’
প্রসঙ্গগত, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে মোহাম্মদ আলী হোসেন অভিযোগে জানান, ২০১৯ সালের ৫ জানুয়ারি রাতে তিনি দুই বন্ধুসহ কষ্টি পাথরের মূর্তি, স্বর্ণ রঙের খোদাই করা আসন, ফার্সি-উর্দু ভাষার তান্ত্রিক কিতাব, রাষ্ট্রীয় নকশা ও ৫৭০টি অদ্ভুত ছবি উদ্ধার করেন। তিনি সরকারকে হস্তান্তর করতে চাইলে কর্ণফুলীর এজাজুর রহমান ও মো. মনির জোরপূর্বক সেগুলো নিয়ে যান। আইনি নোটিশ পাঠানোর পরও তারা হুমকি দেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। তবে কোন ধরনের এসব প্রত্নতত্ত্বের কোন স্থিরচিত্র কিংবা ভিডিও চিত্র দেখাতে পারেননি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button