৮ মার্চ, ২০২৫ (বাসস) : কুড়িগ্রামের মাহফুজার (ছদ্মনাম) বয়স ১৩। সে স্কুলে যাওয়া-আসার পথে বেশ কিছুদিন ইভটিজিংয়ের শিকার হয়। একদিন মাহফুজা ১০৯- এ ফোন করে। সেখানে তারা স্থানীয় মেম্বারকে বিষয়টি জানানোর পরামর্শ দেয়। সে অনুযায়ী মাহফুজা কাজ করে এর সুফল পায়।
মাহফুজা বলে, ‘বাবা-মাকে বলে সমস্যাটির সমাধান পাচ্ছিলাম না। পরে ১০৯ আমাকে পথ দেখিয়েছে। এ ধরনের হেল্পলাইনগুলো আমাদের সকলের জানা থাকা প্রয়োাজন।’
মাহফুজা ঠিক কাজ করেছে। আজকাল সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শিশুদের সামাজিক সুরক্ষার বিষয়ে তাদেরকে সচেতন করে তোলার জন্য নানাভাবে কাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের সামাজিক সুরক্ষা না থাকলে তারা সঠিকভাবে গড়ে উঠতে পারবে না।
ইউনিসেফ-এর এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় ‘বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪০ ভাগ শিশু অর্থাৎ ৬ কোটি শিশু। শিশুর সামাজিক সুরক্ষা কী রকম হওয়া প্রয়োজন জানতে চাইলে সেভ দ্যা চিলড্রেন, বাংলাদেশ-এর ‘শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম’-এর পরিচালক আবদুল্লা আল মামুন বলেন, ‘শিশুদের যে সব অধিকার রয়েছে তা তার পরিবার, স্থানীয় কমিউনিটি, স্থানীয় সরকার এবং রাষ্ট্রকে তা সুরক্ষিত করতে হবে।’
সেভ দ্যা চিলড্রেন শিশুদের সামাজিক সুরক্ষার বিষয়ে কীভাবে কাজ করছে জানতে চাইলে তিনি আবারো বলেন, ‘আমরা সাধারণত সুবিধাবঞ্চিত, দরিদ্র এবং প্রান্তিক শিশুদের জন্য নানাভাবে কাজ করছি। তাদের বাবা-মা বা অভিভাবকদের নিয়ে বৈঠক করি, যেনো তারা শিশুদের সাথে ইতিবাচক আচরণ করেন। স্থানীয় কমিউনিটিকে বলি তাদের বিষয়ে খেয়াল রাখতে বা সচেতন থাকতে। স্থানীয় সরকার তথা মেম্বার-চেয়ারম্যানদের বলি শিশুদের যে কোনো সমস্যায় তারা যেনো এগিয়ে আসেন এবং তাদেরকে সুরক্ষিত করেন। একটু বড় শিশুদের জন্য আমাদের কমিউনিটি ভিত্তিক সেন্টার রয়েছে। সেখানে তাদেরকে বাল্যবিবাহ, সহিংসতা, যৌন হয়রানি ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় আলোচনা ও তথ্য বিনিময় করি। কোনো শিশু সহিংসতার শিকার হলে আমরা তাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা করি। তাদের আইনী সহায়তাসহ অন্য যে কোনো ধরনের সমস্যায় আমরা তাদের পাশে থাকি।’
শিশুর সামাজিক সুরক্ষার বিষয়ে ইউনিসেফও কাজ করছে। চাইল্ড প্রটেকশন স্পেশালিস্ট শাবনাজ জাহিরিন বলেন ‘আমরা ঢাকার কিছু বস্তি এবং ঢাকার বাইরে কিছু ঝুকিপূর্ণ এলাকা যেমন চর, হাওড় এবং চা বাগানের শিশুদেরকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় এনে কাজ করছি। যাতে তারা দরিদ্র পরিবারে থেকেও স্বাধীনভাবে চলতে এবং পড়ালেখা করতে পারে এ জন্য তাদেরকে ১৮ মাসে কয়েকটি কিস্তিতে ২১ হাজার টাকা দেয়া হয়। এতে শর্ত থাকে যে ঐসব শিশুদের পরিবারের সাথে রাখতে হবে এবং তাদেরকে স্কুলে যেতে হবে। তাদেরকে বাল্যবিবাহ দেয়া যাবে না এবং তাদেরকে শিশুশ্রম থেকে বিরত রাখতে হবে ইত্যাদি। ২০১২-২০২১ সাল পর্যন্ত আমরা প্রায় পঞ্চাশ হাজার শিশুকে এভাবে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় এনেছি। এতে আমরা দেখেছি, তারা তাদের জীবনমানের পরিবর্তন আনতে পেরেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘তাদেরকে সচেতন করার জন্য আমাদের কিশোর-কিশোরিদের ক্লাব রয়েছে। সেখানে তাদেরকে জীবন দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেখানে তারা সরাসরি শিখতে পারে কীভাবে চলবে হবে, সচেতন হবে এবং নিজে নিজেকে সুরক্ষিত করা যাবে।’
সরকারের ‘এক্সিডেলিরেশন প্রটেকশন ফর চিলড্রেন (এপিসি)’ নামে একটি প্রকল্প ‘শিশুর সুরক্ষা’ বিষয়ে কাজ করছে। এর সাবেক প্রকল্প পরিচালক এস এম লতিফ বলেন, ‘শিশুদের সামাজিক সুরক্ষার মধ্যে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। সংক্ষেপে বলতে গেলে, রাষ্ট্র তাদের অধিকারের বিষয়টি দেখছে কিনা কিংবা তাদের কোনো অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে কিনা বা তারা কোনো সহিংসতার শিকার হচ্ছে কিনা এ ধরনের বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম বন্ধ করা, শিশু অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে কিনা, শিশুরা সহিংসতার শিকার হচ্ছে কিনা ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে সরকার কাজ করছে তারা। এজন্য সারা দেশে আমাদের ২,১০০ কিশোর-কিশোরি ক্লাব আছে, সেগুলোর মাধ্যমে এসব বিষয়ে আমরা তাদেরকে সচেতন করে তুলছি। এছাড়া কোনো শিশু সহিংসতার শিকার হলে ‘ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার’ এবং ‘ট্রমা কাউন্সিলিং সেন্টার’-এর মাধ্যমে তাদেরকে প্রয়োজনীয় সেবা দেয়া হচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘শিশুরা যাতে দারিদ্রতার কারণে পড়ালেখা বন্ধ না করে সেজন্য উপবৃত্তি, দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত তাদেরকে বিনা বেতনে পড়া এবং নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে সরকার।’
শিশুদের সামাজিক সুরক্ষার জন্য শুধুমাত্র তাদেরকে সচেতন করে তোলা যথেষ্ট নয়, বাল্যবিবাহ, সহিংসতা এবং শিশুশ্রম বন্ধ করাও অপরিহার্য। তারা যাতে স্বাধীনভাবে চলতে পারে এবং নির্বিঘ্নে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে এজন্য পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে আরও আন্তরিক হতে এবং সহযোগিতা করার আহ্বান জানান সংশ্লিষ্টজন।