২৫ মার্চ কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী : মো. আব্দুল মাবুদ
২৪ মার্চ, ২০২৫ (বাসস): ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যশোর সেনানিবাস হতে বেরিয়ে নিরস্ত্র জনগণের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে এবং বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা করে।
পাকিস্তানি সেনারা যশোরের জাতীয় পরিষদের সদস্য মশিউর রহমানকে ঐ রাতে গ্রেফতার করে সেনানিবাসে নিয়ে যায়।
এভাবেই স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মো. আব্দুল মাবুদ। তিনি বলেন, ৭ এপ্রিল আমি ভারতের বনগাঁও শহরে যাই। কিছুদিন বনগাঁও অবস্থানের পর কলকাতায় চলে যাই এবং ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে উপস্থিত হই। পরে শাহাজান সিরাজসহ অন্যান্য জাতীয় ও ছাত্র নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাত করি। তাঁরা যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণে মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে পরামর্শ দেন।
যশোর, খুলনা এবং কুষ্টিয়া জেলাসমূহের ১২৫ জন প্রশিক্ষণার্থী মুক্তিকামী ছাত্রদের নিয়ে ২য় ব্যাচে বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) সদস্যদের নেতৃত্বে কলকাতা হয়ে দেরাদুনের টান্ডুয়ার উদ্দেশে রওনা করি পরে ট্রেনযোগে শিলিগুড়ি যাই।
সেখান থেকে আমাদের পুনরায় ট্রাকযোগে দেরাদুনের টান্ডুয়া সামরিক প্রশিক্ষণ একাডেমিতে উপস্থিত করানো হয়। প্রশিক্ষণ গ্রহণের উদ্বোধনী দিনে ভারতের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান মেজর জেনারেল ওবান আমাদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন।
আমরা জেনারেল ওবানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান এবং তৎকালীন মাউন্টেন আর্মির সহায়তায় উত্তর ভারতের মনোরম দেরাদুন পাহাড়ে অবস্থিত টান্ডুয়া নামক স্থানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি।
প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর আমরা কলকাতার ব্যারাকপুরে ফিরে আসি। আগষ্টের মাঝামাঝি সময় আমি আমার দলকে নিয়ে যুদ্ধ করার লক্ষ্যে ব্যারাকপুর হতে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করি।
আমি যশোর জেলার শার্শা থানার কমান্ডারের দায়িত্ব গ্রহণ করি। এরপর আমার দলসহ শার্শার বাহাদুরপুর নামক গ্রামে উপস্থিত হই। এখানে কয়েকদিন আমরা বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে পরিস্থিতি উপলদ্ধি করতে থাকি এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীসহ রাজাকার, আলবদরদের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য সোর্স নিয়োগ করতে থাকি।
বাহাদুরপুর ছাড়াও শাড়াতলা নামক স্থানে আমাদের আস্তানা গড়ে তুলি। শাড়াতলা, বাহাদুরপুর, রামচন্দ্রপুর, নারকেল বাড়িয়া, শালতা, শিখারপুর, লক্ষণপুর, নিজামপুরসহ ১১৭টি গ্রামের উৎসাহী যুবকদের নিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ দেই এবং যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য তাদের প্রস্তুত করি।
দেরাদুনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিএলএফ সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোখ্য ব্যক্তিত্ব শার্শা থানায় এলাকায় যুদ্ধরত ছিলেন তাদের মধ্যে নজরুল ইসলাম (সাবেক ডিআইজি, চট্টগ্রাম রেঞ্জ) মহিতুল ইসলাম, খবির আহমেদ (অধ্যাপক, নাভারন কলেজ), মনিরুজ্জামান (ব্যাবসায়ী), বাবলু (জনপ্রতিধি চেয়ারম্যান), বাবলা, কেরামত আলী, শহীদ রওশন, শহীদ আব্দুল হামিদ, আজগর আলী (অবসরপ্রাপ্ত রক্ষীবাহিনীর অফিসার), ইকু (ব্যবসায়ী) নাম সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য।
প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে প্রথমে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করি। অতঃপর ঝিকরগাছা থানার অন্তর্গত গদখালী স্থানে আমাদের দলবলসহ চলমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ট্রাকে গভীর রাতে আক্রমণ চালাই।
এরপর দ্রুত সেখান থেকে আমাদের সদস্যদের প্রত্যাহার করে শাড়াতলায় ফিরে যাই। পরে জানতে পারি, এই হামলায় পাকিস্তানিদের একটি ট্রাক ধ্বংস হয়েছে এবং কয়েকজন সেনা সদস্য মারাত্নকভাবে আহত হয়েছে।
উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনাসমূহের মধ্যে শার্শা থানার অন্তর্গত গোড়পাড়া ও গাতিপাড়ায় যুদ্ধের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।
আমাদের অবস্থান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে প্রকাশ হয়ে যায়। তারা আমাদের অবস্থানের প্রতি হামলা করার জন্য সেনাবাহিনী ১ কোম্পানীর ফোর্স আর্টিলারি সাপোর্ট নিয়ে অক্টোবর মাসে গোড়পাড়া পর্যন্ত অগ্রসর হতে সমর্থ হয়। আমরাও গোড়পাড়ার ছোট্ট দুর্গ গড়ে তুলি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কোনো সদস্যকে ছোট্র বেতনা নদী পার হতে দেইনি। যুদ্ধেকে গতিময় করার জন্য আমি ও আমার সঙ্গী ফজলুকে নিয়ে গোড়পাড়া হতে প্রায় ৭ কিমি. দূরে বাংলাদেশের সীমান্ত বরাইতে উপস্থিত হই এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসার মেজর হুদার সাথে (পরবর্তী কর্নেল) সাক্ষাত করি।
পরে ভারতীয় সেনা কমান্ডার কর্নেল আমার সাথে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১ প্লাটুন ফোর্স ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে গোড়পাড়া পর্যন্ত প্রেরণ করে এবং বয়রা হতে আর্টিলারির সাপোর্ট পেতে থাকি। ৩দিন একটানা যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা অবস্থান প্রত্যাহার করে নাভারনে তাদের সেনা ইউনিটে প্রত্যাবর্তন করে। এই যুদ্ধে আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁর সমাধি এখনও বাহাদুরপুর মসজিদের সম্মুখে অবস্থিত।
এদিকে পাকিস্তান রেডিওতে সংবাদ প্রচার করা হয়, তাদের ৩৮ জন সৈন্য হতাহত হলেও আমরা সকলেই নিশ্চিহ্ন। এই যুদ্ধে বিএলএফ সদস্যদের বহু গোলাবারুদ খরচ হয় এবং পরবর্তীতে গোলাবারুদ সংগ্রহের জন্য এরিয়া হেডকোয়ার্টার ব্যারাকপুরে যাই।
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তান সেনা সদস্যরা পুনরায় আমাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ করার প্রস্ততি নেয়। তারা নাভারন হতে আমাদের অবস্থানের দিকে ৪ কি:মি: গাতিপাড়া নামক স্থানে অগ্রসর হয়। আমরাও দ্রুত বয়রা থেকে আর্টিলারি সাপোর্ট পাই এবং একটানা প্রায় ৭ ঘন্টা যুদ্ধের পর পাকিস্তান সেনা সদস্যরা নাভারনে প্রত্যাবর্তন করে।
ঐ সময় আমরা পূর্ণোদ্যমে আক্রমণ করি এবং পাকিস্তান সেনা ইউনিটের ৬/৭ জন সদস্য আমাদের গুলিতে হতাহত হয় বলে জানতে পারি। এরপর আর কোনদিন পাকিস্তান সেনা সদস্যরা আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে সাহস পায়নি।
এভাবে আমরা শার্শা থানা বিস্তৃীর্ণ এলাকা দখলদার পাকিস্তানি সেনা মুক্ত ঘোষণা করি। আমাদের দলের স্থানীয় যুবকরা যখন যুদ্ধে প্রশিক্ষপ্রাপ্ত হয়ে আমাদের সাথে মিলতে থাকে তখন অস্ত্র সংগ্রহের আরো প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে টহলরত রাজাকারদের প্রতি আক্রমণ চালিয়ে প্রায় ৩০টি রাইফেল সংগ্রহ করেছিলাম।
এছাড়া অস্ত্র ও গুলির প্রয়োজন হলে মাঝে মধ্যে যুদ্ধকালীন অবস্থায় কলকাতার ব্যারাকপুরে যেতাম। ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ আমাদের এলাকা শার্শা থানা ও সমগ্র যশোর এলাকা শত্রুমুক্ত হয়ে যায়।
ঐদিন কলকাতা থেকে স্বাধীন বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ও তাঁর তিন ক্যাবিনেট সদস্য ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী , কামরুজ্জামান, শার্শার জাতীয় সংসদ সদস্য তবিবর রহমান সরদারসহ একটা খোলা জীপে করে বেনাপোলে সকাল ১০টার দিকে আসেন।
আমি ও আমার অন্যান্য মুক্তিকামী সহকর্মীরা বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে বাংলার মাটিতে সাদরে অভ্যর্থনা জানাই।
পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধেদের প্রথম অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু পরবর্তীতে স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনিভাবে। অনির্দিষ্টকালের জন্য এই অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
তখন বাংলার জনসাধারণ আকস্মিক এই ঘোষণায় মর্মাহত হয় এবং তাঁরা ৬ দফার বলে বলিয়ান হয়ে স্বাধীনতার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।
২৩ বছরের শাসন, দঃুশাসন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি বিদেশি ও পশ্চিমা উপনিবেশবাদীদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র হতে মুক্ত হতে এবং স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রামে নেমে পড়ে।
ঐ সময় ছাত্র সমাজ প্রদত্ত প্রথম ইস্তেহারের প্রতি সকলেই একাত্নতা ঘোষণা করে এবং সমস্ত এলাকা নিম্নে উল্লেখিত শ্লোগানে মুখরিত হয়, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক। স্বাধীন করো, স্বাধীন করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।
গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়ো, মুক্তি বাহিনী গঠন করো। বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। মুক্তি যদি পেতে চাও, বাঙালি এক হও। বাংলা ও বাঙালির জয় হোক।
এভাবেই স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মো. আব্দুল মাবুদ।