সিসা দূষণ সংকট: বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেল বাংলাদেশি যুবদের পরিবেশ আন্দোলন
ব্যাটারির বেপরোয়া পুনঃব্যবহার ও পরিবেশবিধি উপেক্ষার কারণে বাংলাদেশে সিসা দূষণ মহামারির রূপ নিচ্ছে—এমন উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপির (AFP) সাম্প্রতিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। ইতোমধ্যেই ফ্রান্স২৪, এনডিটিভি, ব্যারন’স, দ্য ম্যানিলা টাইমসসহ ১৫০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায়, দেশের পরিবেশ আন্দোলন ও যুব নেতৃত্বাধীন সচেতনতা কার্যক্রম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এসেছে বড় রকমের সফলতাও।
তরুণদের নেতৃত্বের আন্দোলনে গড়ে ওঠা চলমান জনচাপ ও সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে পরিবেশ অধিদপ্তর গত ৩ মাসে ঢাকায ও এর আশেপাশের ১৬টি অবৈধ সিসা গলানোর কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে এবং ছয়টি অবৈধ চুল্লি ধ্বংস করেছে। সরকারি কর্মকর্তারা নাগরিকদের পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এবং দূষণকারী কারখানার বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানোর আশ্বাস দিয়েছেন। এই অগ্রগতির পেছনে রয়েছে পিওর আর্থ বাংলাদেশ, ইউনিসেফ ও ইয়ুথনেট গ্লোবালের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা।
ইউনিসেফের তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ শিশুর রক্তে উচ্চমাত্রায় সিসা পাওয়া গেছে, যা শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য চরম হুমকি। ফলে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ সর্বোচ্চ সিসা-দূষিত দেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংকটের মূল উৎস হলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহৃত লেড-অ্যাসিড ব্যাটারি (ULAB) পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ ও পরিবেশ অনুমোদন ছাড়া পরিচালিত কারখানা।
এএফপির চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদনটি বলছে, ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা মূল্যের ব্যাটারি শিল্প অনেকটাই নীরবে হয়ে উঠেছে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য এক বিপজ্জনক হুমকি। অবৈধ সিসা গলানোর কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে, কৃষিজমি দূষিত করছে এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে।
পিওর আর্থ বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মিতালি দাস বলেন, “যুব নেতৃত্বের পরিবেশ আন্দোলন এই বাস্তব পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সিসা দূষণ প্রতিরোধে আমরা জন সচেতনতা তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছি। ইয়ুথনেট গ্লোবাল আমাদের গুরুত্বপূর্ণ যুব অংশীদার।”
ইয়ুথনেট গ্লোবালের নির্বাহী সমন্বয়ক সোহানুর রহমান বলেন, “ব্যাটারি কারখানার সিসা শিশু স্বাস্থ্য, কৃষিজমি ও পরিবেশের জন্য চরম হুমকি তৈরি করছে। সচেতনতা ও ধারাবাহিক দাবির মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে, এটা উৎসাহজনক।”
উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান:
– দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ শিশু সিসা বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত (*IEDCR, ICDDR,B*)
– ২ কোটির বেশি বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা (IQ) হারানোর ঝুঁকি (*Lancet, World Bank*)
– বছরে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মৃত্যু হৃদরোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত
– সিসা দূষণে বার্ষিক ২৮ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি—যা জিডিপির ৬-৯ শতাংশ
– ২৬৫টির বেশি অনানুষ্ঠানিক পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ সাইট চিহ্নিত, যেখানে সিসার মাত্রা অত্যন্ত বিপজ্জনক
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সাঈদা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “যেসব ব্যাটারি কারখানা পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া চলছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। শিল্প বন্ধ করাই লক্ষ্য নয়, বরং তাদেরকে পরিবেশবান্ধব কার্যক্রমে বাধ্য করা।”
তিনি দূষণ নিয়ন্ত্রণে ‘পলিউশন রিমেডিয়েশন ফান্ড’ গঠনের প্রস্তাব দেন, যা দিয়ে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনা ও শিল্পকারখানাকে সফল রিমেডিয়েশনের ভিত্তিতে সহায়তা করা হবে।
তিনি আরও বলেন, “সিসাসহ ভারী ধাতুর দূষণ একটি বড় জনস্বাস্থ্য হুমকি। সরকারকে সব অংশীজনকে নিয়ে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং পর্যাপ্ত নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে জনগণের অংশগ্রহণও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
এদিকে, পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও পিওর আর্থের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যার মাধ্যমে সিসা দূষণের বিরুদ্ধে সমন্বিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালানো হবে। পরিবেশ উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করেন, ফ্রান্স সরকারের সহায়তায় এই যৌথ উদ্যোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তন আনতে পারে।
তরুণ পরিবেশকর্মী সোহানুর রহমান আরও বলেন, “মানুষ চাইলে পরিবর্তন সম্ভব। ব্যবহৃত ব্যাটারির নিরাপদ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ নিশ্চিত করতে হবে, শিশুদের দূষিত এলাকায় যাতায়াত বন্ধ করতে হবে এবং সরকারের কাছে কঠোর পরিবেশ আইন ও বাস্তবায়নের দাবি জানাতে হবে।”
তিনি বলেন, “কমিউনিটিকে সচেতন ও সম্পৃক্ত করে দূষণ মনিটরিংয়ে যুক্ত করতে হবে। আমাদের সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। এখনই সম্মিলিত পদক্ষেপ নেওয়ার সময়। না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।”