প্রার্থী বাছাই ও ইশতেহারে ব্যস্ত বিএনপি
নির্বাচন এবং নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলন প্রস্তুতি একসঙ্গে নিচ্ছে বিএনপি। মাঠের কর্মসূচির পাশাপাশি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিএনপি নেতারা। তলে তলে প্রতিটি আসনে চলছে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ। তৈরি করা হচ্ছে নির্বাচনী ইশতেহার। এ জন্য সাবেক আমলা ও দলীয় চেয়ারপারসনের একজন উপদেষ্টার নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করা হয়েছে। তারা প্রাথমিকভাবে একটি ‘খসড়া ইশতেহার’ তৈরি করে দলীয় হাইকমান্ড তারেক রহমানের কাছে পেশ করবেন।
দলের একাধিক নীতিনির্ধারকসহ সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। আরও জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সারা দেশে ৩০০ আসনে প্রার্থী বাছাই শুরু করেছে বিএনপি। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক আগামী জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার আগে থেকেই প্রার্থী বাছাই শুরু করে বিএনপি। প্রতিটি সংসদীয় আসন থেকে তিনজনের নাম ঠিক করে ৩০০ আসনের বিপরীতে ৯০০ জনের নামের একটি তালিকা ঠিক করে সেটি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সেখান থেকে একজন করে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। এগিয়ে রাখা হচ্ছে দলের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নের কাজও। ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিস্তারিতভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে আরও আকর্ষণীয় করা হচ্ছে এটিকে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে আরও বেশকিছু নতুন বিষয় সংযোজন ও বিয়োজন করে নির্বাচনের আগে তা চূড়ান্ত করা হবে। বিশেষ করে গণতন্ত্র মঞ্চসহ সমমনা দলগুলোর পরামর্শ ও দাবি অনুসারে রাষ্ট্রের সংস্কার সংক্রান্ত অনেকগুলো বিষয় যুক্ত করা হবে। এ বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনের জন্য সব সময়ই প্রস্তুত। প্রস্তুতির কোনো অভাব নেই। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার আজকে প্রতিষ্ঠিত হলে বিএনপি কালকেই নির্বাচনে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু মানুষ যাতে তার ভোটটা এবার ঠিকমতো নিজের পছন্দের প্রার্থীকে দিতে পারে- সে জন্যই বিএনপি ১০ দফা দাবিতে আন্দোলন করছে। এটা এখন সমগ্র দেশবাসীর দাবি। সব গণতান্ত্রিক দল ও সংগঠনের দাবি। এদিকে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বিএনপি প্রার্থী বাছাই করছে তিন ধাপে। প্রথমত, যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে তারেক রহমান সরাসরি বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি সম্ভাব্য তালিকা তৈরি করছেন। দ্বিতীয়ত, দলের সিনিয়র নেতা তথা পার্লামেন্টারি বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ফাইলওয়ার্ক করে আরেকটি তালিকা তৈরি করছেন। তৃতীয়ত, সরাসরি তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে একটি তালিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ তিনটি তালিকা সমন্বয় করে ৩০০ আসনের জন্য প্রথমে ৯০০ জনের একটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। সেখান থেকেই পরে সময়মতো একজন করে প্রার্থী নিয়ে তালিকাটি চূড়ান্ত করা হবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে বলেন, বিএনপি দেশের একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। তাই গণতান্ত্রিক দলের নির্বাচনের প্রস্তুতি সব সময়ই থাকে। বিএনপিরও আছে। নির্বাচন করার মতো অসংখ্য যোগ্য নেতা আছেন বিএনপিতে। তবে এই মুহূর্তে নির্বাচন নয়, রাজপথের আন্দোলন নিয়ে ভাবছে বিএনপি। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে শিগগিরই যুগপৎ আন্দোলন শুরু করা হবে। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা হলে বিএনপি যাকে যেখানে মনোনয়ন দেবে সে-ই বিজয়ী হবে। আমাদের এখন একটাই লক্ষ্য- নিরপেক্ষ সরকার ও নিরপেক্ষ ইসির অধীনে নির্বাচন। জানা গেছে, মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা নিজ নিজ এলাকায় দলীয় কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি গণসংযোগও শুরু করে দিয়েছেন। প্রচার-প্রচারণাও চালাচ্ছেন। ডিজিটাল ব্যানার, বিলবোর্ডসহ এলাকার বিভিন্ন স্থানে নানা রঙের পোস্টার সেঁটে আওয়াজ দিচ্ছেন তাদের নির্বাচনী তৎপরতার কথা। বিএনপি কেন্দ্রীয়ভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও বন্ধ নেই দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের স্ব স্ব এলাকায় আগাম প্রস্তুতি কার্যক্রম। এবারের কোরবানির ঈদ ঘিরেও বেশির ভাগ নেতা নিজের এলাকায় নানা কর্মসূচি সাজিয়েছেন। নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা আরও বেশি তৎপর হয়ে উঠেছেন। বিএনপির সিনিয়র নেতারা দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিলেও জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে দলটি। এ জন্য ভিতরে ভিতরে এই প্রস্তুতি জোরদার করা হচ্ছে। তবে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে চাপে রাখতেই মূলত বিএনপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মী ধারাবাহিকভাবে বলে যাচ্ছেন- আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবেন না। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রার্থী বাছাইয়ের অংশ হিসেবে যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সিনিয়র নেতাদের পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়ের বিভিন্ন নেতার সঙ্গেও নিয়মিত বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করছেন। এ সময় তিনি তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের কাছ থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন। এ জন্য তিনি তৃণমূল নেতাদের কাছ থেকেও তথ্য জেনে নিচ্ছেন। যে তথ্যগুলো তিনি বেশি জানতে চাচ্ছেন তার মধ্যে রয়েছে- প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় এবার বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থী কে কে? এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় কে? বিএনপির দুর্দিনে কার ভূমিকা কী ছিল? এলাকায় অতীত রাজনীতি ও সামাজিক কর্মকান্ডে কার কী অবদান এবং কাকে প্রার্থী করলে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি? অন্যদিকে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ছয় মাসের মতো সময় বাকি থাকলেও বিএনপি রাজপথের আন্দোলনের পাশাপাশি এ নির্বাচনের প্রস্তুতিও জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছে। বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মতে, রাজপথের আন্দোলন আর নির্বাচন দুটোই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের অংশ। কারণ, রাজপথের শোডাউন বা শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে সরকারের অবস্থান নড়বড়ে করা ছাড়া নির্বাচনে অংশ নিয়ে ১৬ বছরের এই পুরনো আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে তেমন একটা সুবিধা করা যাবে না। এ জন্য নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ও নিরপেক্ষ ইসির দাবিতে সমমনা দলগুলোকে নিয়ে রাজপথে যুগপৎ আন্দোলন ক্রমান্বয়ে জোরদার করতে চায় বিএনপি। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা চলছে। ঢাকায় কর্মরত কূটনীতিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার পাশাপাশি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশে লবিং জোরদার করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, আপাতত জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে বিএনপি যতই নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করুক না কেন- শেষ পর্যন্ত তারা দলের স্বার্থেই নির্বাচনে যাবেন। কারণ, নির্বাচনে না গেলে দলের নেতা-কর্মীরা আরও বেশি হতাশ হয়ে পড়বেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ এ প্রসঙ্গে বলেন, বিএনপি সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক একটি রাজনৈতিক দল। দলটি কখনোই নির্বাচনের বিরুদ্ধে ছিল না। তবে বিএনপি এবার সেই নির্বাচনে যেতে চায়, যে নির্বাচনে জনগণ তাদের নিজেদের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে পারবে। এ জন্যই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে আন্দোলন চলছে। দলীয় নীতিনির্ধারকদের মতে, বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা না নেওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ের ওপর। বিএনপির ঘোষণা অনুযায়ী, বর্তমান সরকারের অধীনে দলটি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে না। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। বিএনপির সঙ্গে একই দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করছে সমমনা দলগুলো। জানা গেছে, দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের সিদ্ধান্ত অনুসারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না বিএনপি। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি দুটোই একসঙ্গে চালাচ্ছে দলটি। বাইরে আন্দোলন করলেও ভিতরে ভিতরে পুরোদমেই চলছে ভোটের প্রস্তুতি। যাতে যে কোনো মুহূর্তে বিনা চাপে ভোটে অংশ নিতে পারে। এ জন্য ৩০০ আসনেই প্রাথমিক মনোনয়ন চূড়ান্ত করতে ভিতরে ভিতরে কাজ চলছে। নানা মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়ে প্রতি আসনে দুজন করে সম্ভাব্য প্রার্থী বাছাই করবেন হাইকমান্ড। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিটি সংসদীয় আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকা ধরে দলীয় কর্মসূচি পালনসহ নানা ইস্যুতে নিজ নিজ এলাকায় থাকার মৌখিক নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, নির্বাচনী বড় ‘প্ল্যান’ নিয়েই এবার আটঘাট বেঁধে মাঠে নামছে বিএনপি। চূড়ান্ত করা হচ্ছে আগাম প্রস্তুতি। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে যুগপৎ আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনোত্তর জবাবদিহিমূলক কর্মসূচির রূপরেখাও প্রায় চূড়ান্ত।