যশোরের ভৈরব নদ এখন যেন খাল
যশোর শহরের দড়াটানার পশ্চিমপাশে ভৈরব নদের তীরের ৮৪টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছিল গত তিন বছর আগে। কিন্তু পূর্ব প্রান্তের দেড় শতাধিক অবৈধ স্থাপনা ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। অবশিষ্ট দখলদার উচ্ছেদ করতে ওই সময় তোড়জোড় করেও শেষ পর্যন্ত থেমে যায় প্রশাসন। সেই দখলদার রেখেই ভৈরব খনন শেষ করতে যাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। আগামী জুলাই মাসের শেষে বা আগস্ট মাসের শুরুতে তারা কাজ সমাপ্ত করবেন। এখন চলছে নদের দুই ধারে হাঁটার ও সৌন্দর্য বর্ধন করার কাজ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভৈরব নদকে খননের নামে খালে রূপ দেয়া হয়েছে। নেই কোন জোয়ারভাটা। প্রভাবশালী দখলদারদের বাধার কারণে এই প্রকল্প’র পুরো সফলতা আসলো না। এতে করে সরকারের অর্থ অপচয় হলো।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) যশোর কার্যালয় মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০১৬ সালে ২৭২ কোটি টাকার ৯২ কিলোমিটার নদ খনন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। শুরু হয় পাঁচ বছর মেয়াদি ভৈরব রিভার বেসিন এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্প। শহর অংশের চার কিলোমিটার এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ছাড়া খনন কাজ করা সম্ভব ছিল না। এ জন্য জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে নদের দুইধারে জেলা প্রশাসনের খাসজমি এবং সড়ক ও জনপদ বিভাগের জমিতে গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনার তালিকা তৈরি করে প্রশাসন। সবমিলে ভৈরব নদের গর্ভে ও তার পাড়ে সরকারি জমিতে গড়ে তোলা ২৯৬ অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি উচ্ছেদের চূড়ান্ত নোটিশ দেয়া হয়। নোটিশ পাওয়ার পরদিনই বেশ কয়েকজন নিজেদের বৈধ মালিক দাবি করে জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন করেন। পরে তারা উচ্ছেদ বন্ধে উচ্চ আদালতের দারস্থ হন। সবশেষ ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ ৮৪টি স্থাপনা উচ্ছেদ করে। অবশিষ্ট দেড় শতাধিক স্থাপনা এখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। গত তিন বছরে এই উচ্ছেদ নিয়ে আর টুÑশব্দ শোনা যায়নি। ইতোমধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ দু’বার বাড়ানো হয়েছে। বর্ধিত মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী জুলাই মাসের শেষে। খনন কাজ শেষ প্রান্তে। চলছে দুই ধারের হাঁটার পথ ও সৌন্দর্য বর্ধন করার কাজ।
সূত্র মতে, ২০১৯ সালের ৩০ জুলাই নিজেদের ওয়েবসাইটে এসব দখলদারদের তালিকাটি প্রকাশ করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। যশোর সদরে ভৈরব দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করা সেই তালিকায় রয়েছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, জনতা সুপার মার্কেট, সম্রাট সুজ, প্রাইম সুজ, ছিট বিতান, এ্যানি সুজ, একতা ক্লথ স্টোর, তাসলিমা টেলিকম, সাদিকের মাংসের দোকান, বিভিন্ন চায়ের দোকান, বাসা বাড়িসহ ৮৫ জন। কিন্তু এ দখলদারদের কেউ উচ্ছেদ হয়নি। উপরন্তু ক্লিনিক ও হাসপাতালের বর্জ্য নদে ফেলে নদ দূষণ করা হচ্ছে।
এদিকে খনন শেষে দড়াটানা থেকে বাবলাতলা ব্রিজ পর্যন্ত নদের দক্ষিণ প্রান্ত ও গরীবশাহ মাজার থেকে দড়াটানা পর্যন্ত হাঁটার পথ করছে পাউবো। হাঁটাচলার রাস্তা ও সৌন্দর্য বর্ধন কাজ করা হবে দখলদার রেখেই। আর সেটা হলে দখলদাররা স্থায়ী দখল রাজত্বের সুযোগ পেয়ে যাবেন বলে মনে করছেন শহরের বিশিষ্টজনেরা।
ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলন কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, নদ-নদী প্রবাহমান হতে হলে প্লাবনভূমি দরকার। ১৯২৬ সালের ভূমি জরিপ (এসএ) রেকর্ড অনুযায়ী ভৈরব নদ চুয়াডাঙ্গার মাথাঙ্গা নদীর সঙ্গে সংযোগ হবে। কিন্তু যশোর শহর অংশে ভৈরবের কোন প্লাবনভূমি নেই। প্লাবনভূমি নীতিমালা মানা হয়নি। দুই পাড়জুড়ে বহুতল ভবন। এটা ভৈরবের জন্য দুঃখজনক। নদটিকে খননের নামে খালে রুপ দেয়া হয়েছে। সরকারের অর্থ অপচয় হলেও এই খনন দিয়ে শহরের মানুষের কোন উপকার হবেনা। বর্তমান ক্ষমতাসীন এক রাজনীতিক ও পাউবোর অসাধু কর্মকর্তারা মিলে নদ-নদী হত্যার জন্য দায়ী থাকবেন।
জনউদ্যোগ যশোরের আহবায়ক প্রকৌশলী নাজির আহমেদ বলেন, ভৈরব রক্ষায় জনউদ্যোগের পক্ষ থেকে বহুবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছি। আমাদের দাবি ছিল প্রথমে দখলদার উচ্ছেদ করতে হবে। এরপর নিয়মমাফিক ভৈরব খনন করে সৌন্দর্যবর্ধন করা। কিন্তু দখলদার উচ্ছেদ করা হয়নি। খননও দৃশ্যমান হয়নি। এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। নদকে খালে রূপান্তর করা হয়েছে।
এ বিষয়ে পাউবো যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী একেএম মমিনুল ইসলাম বলেন, চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসের শেষে অথবা পরের মাস আগস্টে শেষ হয়ে যাবে। নদের গভীরতা তলায় ৩২ মিটার ও উপরে ৪৮ মিটার করার যে নিয়ম ছিল সেটাই করা হয়েছে। জুয়ারভাটা আসবে বলে আমরা আশাবাদী। এখন খননকাজ শেষ প্রান্তে। একই সাথে চলছে সৌন্দর্ষবর্ধন করণের কাজ।