চট্টগ্রাম

কার ভুলে তছনছ ‘পুরাতন ব্রিজঘাট’

জে. জাহেদ, চট্টগ্রাম:

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কতৃপক্ষ (সিডিএ) এর অধিগ্রহণকৃত জমিতে আইনি মারপ্যাচে উচ্ছেদ অভিযান থেমে গেলেও পুনরায় সিডিএ’র উচ্ছেদে তছনছ হয়ে গেছে কর্ণফুলী উপজেলার পুরাতন ব্রিজঘাট। অভিযানে প্রায় ৫০০ ব্যবসায়ি তাদের দোকানের স্থান হারালেও সিডিএ’র পক্ষ থেকে কোন স্থায়ী ভাবে দোকান নির্মাণের কোন আশ্বাস পাওয়া যায়নি। বরং গত তিন মাসে টানা কয়েকবারের উচ্ছেদ অভিযানে আনোয়ার সিটির একাংশ, ছৈয়দপুর মার্কেটের একাংশ, হাজী টাওয়ার, চরপারথরঘাটা ইউনিয়ন পরিষদ, নুর মার্কেটের একাংশ, মসজিদ প্রাঙ্গণ ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি এ অভিযানে পুরাতন ব্রিজঘাটের কয়লার মাঠ ও সড়কের পাশে থাকা দোকান সমূহ উচ্ছেদ করা হয়েছে। সিডিএ’র স্পেশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ) বেগম তাহমিনা আফরোজ চৌধুরীর নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে সিডিএ নির্মাণ বিভাগ-১ এর প্রকৌশলী কাজী কাদের নেওয়াজ টিপু, সিডিএর এস্টেট শাখার অফিসার মো. আলমগীর খান, সিডিএর সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফারুক, পেশকার ফয়েজ আহমদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সিডিএর এস্টেট শাখার অফিসার মো. আলমগীর খান বলেন,‘পুরাতন ব্রিজঘাট কাঁচা বাজার ও পাশের সিডিএ খেলার মাঠ ও কয়লার মাঠের জায়গায়টি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) এর দখলীয় ও মালিকানাধীন জমি বলে দাবি করে প্রতিষ্ঠানটির। অধিগ্রহণ করা জমিটি রাস্তা নির্মাণের অবশিষ্ট জমি। ভবিষ্যতে রাস্তা সম্প্রসারণ করার জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। এলএ মামলা ও বিএস খতিয়ান মূলে জমিটি সিডিএ’র। তাই এ জমিতে থাকা অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। উচ্ছেদে মামলার কোনো বাধা নেই বলে তিনি জানান।’

উচ্ছেদের বিষয়ে সিডিএ নির্মাণ বিভাগ-১ এর প্রকৌশলী কাজী কাদের নেওয়াজ বলেন, ‘চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) এর আওতাধীন এলাকা কর্ণফুলী নদীর বামতীর মইজ্জারটেক হতে স্টোর ইয়ার্ড ফর ফ্লোটিং ব্রিজ (ভাসমান সেতু) পর্যন্ত (পিসি রোড) সড়কের উভয় পার্শ্বে ভাসমান অবৈধ স্থাপনা/অবকাঠামো উচ্ছেদ করা হয়েছে। ওই জমিতেই এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন যাবত কাঁচা বাজার বসিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য করতেন।’

স্থানীয়রা জানান, বাজার না থাকায় চরপাথরঘাটা ও চরলক্ষ্যার ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ক্ষুদ্র মাছ ব্যবসায়ীরা জানান, বাজার উচ্ছেদ করলেন সিডিএ, ক্ষতি হল ব্যবসায়ীর। উধাও হয়ে গেল পজিশন বিক্রি করা জমিদাররা। বিনা নোটিশে সিডিএ’র অভিযানে এর আগেও অন্তত পাঁচ শতাধিক দোকান গুড়িয়ে দিয়েছে। সিডিএর আকস্মিক অভিযান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের স্থায়ী ভাবে বাজার প্রতিষ্ঠার দাবি জানান সিডিএ’র কাছে।

ওদিকে, কয়লার মাঠে সিডিএ এবং দখলদারের মধ্যে আইনি লড়াইয়ে আদালতের স্থিতাবস্থাও থাকলেও সিডিএ তা নিষ্পত্তি হয়েছে বলে ২০ বছর ধরে যুবলীগ নেতার দখলে থাকা কয়লার মাঠ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। দখলদার দাবি করেছেন, ‘১৯৬৬-৬৭ সালে জমিটি তাঁর পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে সরকার অধিগ্রহণ করেছিলেন ভাসমান ব্রিজের জন্য। কিন্তু বর্তমানে কোন ভাসমান ব্রিজের অস্তিত্ব নেই। জমিটিও পরিত্যক্ত পড়ে আছে। অধিগ্রহণের শর্ত মোতাবেক ওই জমি সরকারের কাজে ব্যবহৃত না হলে মূল মালিক ব্যবহার করতে পারেন। এ কারণে মাঠটি তারা দখলে রেখেছেন।’

এ বিষয়ে সৈয়দ আহমদ গং এর পক্ষে আনোয়ার সাদাত মোবারক বাদি হয়ে সিডিএ’কে বিবাদি করে তৃতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালত চট্টগ্রামের দায়েরকৃত অপর মামলা-২৪৩/০৩ সালে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্তে বিজ্ঞ আদালত গত ২০১৬ সালের ১৪ নভেম্বর তারিখে ৭১ নং আদেশের সংক্ষুব্ধে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে সিভিল রিভিশন নং-৪৪১৪/১৬ ইং মামলায় তপশীলের সম্পত্তিতে স্থিতবস্থায় আদেশ প্রদান করেন এবং রুল জারি করেন। বর্তমানে মামলাটি হাইকোর্টে বিচারাধীন।’

যুবলীগ নেতা আনোয়ার সাদত মোবারক বলেন, ‘ওই জমি নিয়ে আমরা মহামান্য হাইকোর্টে মামলা করেছি। নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আগামী ২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। কিন্তু এর পরেও সিডিএ অভিযান পরিচালনা করেছে। আমি আবারো আইনের আশ্রয় নেবো।’

তথ্য মিলে, চরপাথরঘাটা মৌজার ৩ নং খতিয়ানে সিডিএ এর ১৫ দশমিক ৩৮ একর জমি রয়েছে। ওই খতিয়ানের বিএস ২৫ দাগটি হলো কয়লার মাঠ। যেখানে মোট ৩ একর জমি আছে। খতিয়ানে দখল বিষয়ক মন্তব্যে একটি দালানেরও অস্তিত্ব মিলে। বর্তমান জমিটির বাজার মূল্য ৪৫ কোটি টাকার সম্পত্তি প্রায়। একই খতিয়ানে ৬৮ দাগটি পুকুর। এ দাগে জমি আছে ১ একর ৫৭ শতক।

বিশেষ সূত্রে আরও তথ্য মিলে, ২০০৬ সালে বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস ঢাকা ০৬ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে খালেদা জিয়ার মন্ত্রী সভায় যোগ দেন। ওই সময় তিনি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। পরে উনার এক আত্বীয়ের মেসার্স সাবরিনা এন্টারপ্রাইজের নামে বর্তমান কয়লার মাঠ ও তৎকালিন পুকুরের জমিটি ইজারা নিয়েছিলেন। যেহেতু সিডিএ এখনো গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গত ৬ বছরে সিভিল রিভিশন ৪৪১৭/১৬ মামলাটি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক মো. এমদাদুল হক আজাদ কোর্ট নং-১১ (এনেক্স বিল্ডিং), কোর্ট নং-১৩ (মেইন বিল্ডিং) বিচারক মাহমুদুল হক, কোর্ট নং-০৮ (মেইন বিল্ডিং) এর বিচারক এ কে এম শাহিদুল হক ও সর্বশেষ এনেক্স বিল্ডিং ৭নং কোর্টের বিচারক মো. মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরীসহ সকলেই মোট ৬ বার শুনানি করেছেন। এতে বাদিপক্ষ প্রথমে ১ বছরের স্থিতবস্থার আদেশ পান। পরে আরও ১ বছর, এরপর আরও ৬ মাস ও সর্বশেষ গত বছরের ১৯ জানুয়ারি আদেশ পান ‘পূর্ব প্রদত্ত স্থিতাবস্থার আদেশটি মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ থেকে বিধি অনুসারে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বাড়ানো হোক।’

এলাকার সাধারণ লোকজন ও চরপাথরঘাটার ব্যবসায়িরা বলেছেন, ‘দীর্ঘ ১৫ বছর পর ব্রিজঘাট কাঁচাবাজার ইজারা ও সিডিএ’র জমি খাস ঘোষণার পরেই উপজেলা প্রশাসন ও সিডিএ’র মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এ নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে অনেক চিঠি চালাচালি হলেও কোন সুরানা হয়নি। অনেকেই এর জের ধরে সিডিএ উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে বলে জানান। কিন্তু সিডিএ বলছেন এটি তাঁদের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এর আগেও একাধিকবার উচ্ছেদ করা হয়েছে। ২০০৩ সালেও এসব স্থাপনা ভেঙেছিলেন।’

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ এর মুঠোফোনে ফোন করা হলেও মিটিং এ ব্যস্ত বলে ফোন লাইন কেটে দেন। পরে কয়েক ঘন্টা পর আবারো কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button