বিদ্যুৎ বিল ইস্যুতে উৎকন্ঠায় ৩ হরিজন পল্লীর ২০০ পরিবার,কাঁধে ৫ কোটি টাকা বকেয়া বোঝা
যশোরে হরিজনদের কাঁধে এখন পাঁচ কোটি টাকার বকেয়া বিলের বোঝা। যশোর পৌর কর্মকর্তারা বলছেন এখন থেকে হরিজনদের বিদ্যুৎ বিলের দায় আর নেবে না পৌরসভা। আবার ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ তাদের বকেয়া প্রায় ৫ কোটি টাকার বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের জন্য জোর তাগিদ দিচ্ছে। এর অংশ হিসেবে সোমবার উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কয়েকটি টিম ৩টি হরিজনপল্লীতে গিয়ে প্রিপেইড মিটার লাগানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন যাতে আগে টাকা দিয়ে বিদ্যুৎ কিনে ব্যবহার করেন সে লক্ষে নেয়া উদ্যোগ কার্যকর হয়নি বাধার মুখে।
হরিজন সম্প্রদয়ে নেতারা পৌরসভার সাথে সংলাপ করতে এক সপ্তার সময় চেয়েছেন। ৫ কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিলের বোঝা মাথায় থাকায় নানা শংকা ও উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন যশোর শহরের ৩টি হরিজন পল্লীর দু’শতাধিক পরিবার। তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলে কিংবা প্রিপেইড মিটার সংযুক্ত করলে আন্দোলন, এমনকি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অফিস ও বাসায় নোংরা আবর্জনা ফেলে সয়লাব করার হুমকি দিয়েছেন।
ওজোপাডিকো কর্মকর্তারা বলছেন, পৌরসভা দিনের পর দিন বিল পরিশোধের নামে তালবাহানা করে চলেছে। বিশেষ করে হরিজন পল্লীর ৩টি মিটারের ব্যাপারে উদাসীনতার পরিচয় দিচ্ছেন পৌরকর্তৃপক্ষ। সময় নিলেও কার্যকর করছে না। আর হরিজনদের মুখোমুখি করছে বিদ্যুৎ বিভাগকে।
ওজোপাডিকোর বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ যশোর ও যশোর পৌরসভা থেকে তথ্য মিলেছে, ব্রিটিশ আমল থেকে যশোরে হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজনের জীবন জীবিকা অনেকটাই পৌরকর্তৃপক্ষ দেখভাল করে আসছেন। বিশেষ করে তাদের কাজ, বেতন বা সম্মানী, আবাসন সবই। যশোরের ৩টি হরিজন পল্লীর (ডোম সুইপার) লোকজনের বিদ্যুৎ বিল বহন করে আসছিলেন পৌর কতৃপক্ষ। ২০০৭ সাল পর্যন্ত যশোর পৌর কর্তৃপক্ষ হরিজনপল্লীর লোকজনের বিদ্যুৎ বিল বহন করেছে। এর মধ্যে যশোরের পুরাতন পৌরসভা ভবনের সামনে, আর এন রোড তালতলা পিকআপ স্ট্যান্ডের পাশে এবং রেল রোডের পাশের হরিজন পল্লীতে পৌরসভার নামে ১টি করে যে ৩টি মিটার দেয়া রয়েছে, সেখানে বিদ্যুৎ বকেয়া পড়েছে ৫ কোটি টাকা। সরকারি উদ্যোগে ২০০৭ সালে কিছু পরিমাণ টাকা পরিশোধ করে বিদ্যুৎ বিভাগকে। এরপর থেকে ওই ৩টি পল্লীর টাকা বকেয়া পড়ে আছে। পরিশোধের ব্যাপারে বার বার তাগিদ দেয়া হলেও অর্থ সংকটের কারণে পৌরসভা পরিশোধ করতে পারেনি। দিন দিন বকেয়ার পাল্লা আরো ভারি হচ্ছে। আবার পৌরসভা এখন থেকে আর দায় নিতে চাইছে না। পৌরসভার নামে না রেখে হরিজন পল্লীর লোকজনের পরিবার প্রতি নামে নামে প্রিপেইড মিটার দেয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন পৌরকর্তৃপক্ষ। এ কারণে উর্ধ্বতনদের সাথে সংলাপ করে ওজোপাডিকো যশোর মাঠে নেমেছে বকেয়া আদায় ও প্রিপেইড মিটার সংযোগ দিতে। ২৯ জানুয়ারি পুরাতন পৌরসভা ভবনের সামনে, আর এন রোড তালতলা পিকআপ স্ট্যান্ডের পাশে এবং রেল রোডের পাশের হরিজন পল্লীতে যান বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা। সাথে নিয়ে যান প্রিপেইড মিটার। রেলরোডের হরিজন পল্লীতে বিদ্যুৎ বিল বকেয়া ২ কোটি ৬২ লাখ টাকা। সেখানে প্রিপেইড মিটার লাগাতে গেলেও বাধার সম্মুখিন হন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীগন। কাজ শুরু করলেও বাধা দেন হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন। এদিন দুপুরে ৩টি টিম যায় তিনটি পল্লীতে। কার্যক্রমে উপস্থিত ছিলেন ওজোপাডিকোর বিদ্যুৎ বিক্রয় বিতরণ বিভাগ খুলনার চীফ ইঞ্জিনিয়ার আবু হাসান, বিদ্যুৎ বিক্রয় বিতরণ বিভাগ যশোরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী অমূল্য কুমার সরকার, খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শহিদুল আলম, বিদ্যুৎ বিক্রয় বিতরণ বিভাগ যশোর ১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী নাসির উদ্দিন, বিদ্যুৎ বিক্রয় বিতরণ বিভাগ যশোর-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী জিএম মাহমুদ প্রধান, সহকারী প্রকৌশলী শামসুজ্জোহা কিরনসহ সিনিয়র অফিসারবৃন্দ। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তারা চেষ্টা ও হরিজনদের সাথে সংলাপ করেও শেষ পর্যন্ত মিটার লাগাতে পারেননি।
অভিযানিক অফিসার সহকারী প্রকৌশলী শামসুজ্জোহা কিরণ জানিয়েছেন, কয়েকটি গাড়ি ও জনবল প্রিপেইড মিটার নিয়ে গেলেও লাগাতে দেননি হরিজন সম্প্রদায়ের লোকেরা। প্রিপেইড লাগালে আগে টাকা দিয়ে বিদ্যুৎ পোড়াতে হবে। আর এ কারণে তারা শঙ্কিত হয়ে এমনটি করেছেন।
এদিকে প্রিপেইড মিটার সংযুক্ত ও সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হতে পারে এ খবরে রেল রোড হরিজন পল্লী ও পুরাতন পৌরসভার সামনের পল্লীতে যাওয়া হয় গ্রামের কাগজের পক্ষে। এসময় হরিজন ঐক্য পরিষদের সহসভাপতি আনন্দ দাস, হরিজন সম্প্রদায়ের নেতা পান্না লাল, জীবন লাল পান্ডেম, সাধু হরিজন, মান্না, সুমনসহ অনেকেই জানান, ব্রিটিশ আমল থেকে তাদের বাপ দাদারা বসবাস করে আসছেন। তবে কখনও তাদের বিদ্যুৎ বিল দিতে হয়নি। প্রিপেইড মিটার দেয়া মানে তাদের বিদ্যুৎ বিল আগে দিয়ে ব্যবহার করতে হবে। পৌরসভা তাদের মাত্র ৩ হাজার টাকা করে বেতন দেয়। তা দিয়ে কি হয়। বছরের পর বছর পৌরকর্তৃপক্ষ তাদের সাথে তামাশা করে আসছে। বেতন ভাতা না বাড়িয়ে বিদ্যুৎ বিল তাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এটা বড় অমানবিক বিষয়। শুনছি তাদের উপর কয়েক কোটি টাকার বকেয়া বিল চাপবে। এটাতে তারা শঙ্কিত। বিল দিলে দেবে পৌরসভা। এ নিয়ে কয়েকবার পৌর মেয়রের সাথে তারা কথাও বলেছেন। এখন প্রিপেইড মিটার লাগানো যাবে না, সংযোগ বিছিন্নও করা যাবে না। হরিজন সম্প্রদায়ের নেতারা আগে পৌর কর্তৃপক্ষের সাথে বসবে, কথা বলকে। এরপর জানানো হবে বিদ্যুৎ বিভাগে। হটকারি কায়দায় সংযোগ বিছিন্ন করলে কিংবা প্রিপেইড মিটার লাগালে আন্দোলন করা হবে। এমনকি নোংরা ময়লা আবর্জনা ফেলা হবে সংশ্লিষ্ট অফিসারদের বাসায় ও অফিসে।
তারা আরো জানান, পরিচ্ছন্নতা কাজে অনেক অহরিজনদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এডিবি প্রকল্পের অজুহাত দেখিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহে এনজিওদের দায়িত্ব দিয়েছে পৌরসভা। এতে পেশা সংকটে পড়ছে অনেক হরিজন। এরপর আবার বিদ্যুৎ বিল চাপিয়ে দিলে ভাল হবেনা। কঠোর প্রতিবাদ জানানো হবে।
হরিজন পল্লীতে চলমান কার্যক্রম নিয়ে কথা হয় ওজোপাডিকোর বিদ্যুৎ বিক্রয় বিতরণ বিভাগ খুলনার চীফ ইঞ্জিনিয়ার আবু হাসানের সাথে। তিনি গ্রামের কাগজকে জানিয়েছেন, আর কতদিন বকেয়া রাখা হবে। ৩ টি হরিজন পল্লীতে বকেয়া ৫ কোটি টাকার উপরে। তাদের প্রিপেইড মিটার দেয়া ছাড়া পথ খোলা নেই। বকেয়া পরিশোধের জন্য পৌরসভাকে বারবার বলা হয়েছে, নোটিশ করা হয়েছে। বর্তমান পৌর মেয়র হায়দার গনী খান পলাশ দ্রুত পরিশোধ করবেন বলেও জানিয়েছেন। তিনি এখন ঢাকাতে অবস্থান করছেন। সোমবার হরিজন পল্লীতে প্রিপেইড মিটার লাগাতে গেলে সময় চেয়েছেন বাসিন্দারা। তারা দুদিন সময় চেয়েছেন। পৌরসভার সাথে তারা কথা বলতে চান। মানবিক কারণেই সময় দেয়া হয়েছে। বকেয়া টাকা শোধ না করে পৌর কর্তৃপক্ষ তালবাহানা করে আসছে, যা কাম্য নয়। দ্রুত টাকা পরিশোধ না করলে প্রয়োজনীয় কঠোর পদক্ষেপ নেবে বিদ্যুৎ বিভাগ।
এ ব্যাপারে যশোর পৌরসভার প্রকৌশলী কামাল আহমেদ জানিয়েছেন, একে একে বকেয়া বিদ্যুৎ বিলগুলো পরিশোধ করবে পৌরসভা। তবে এখন থেকে হরিজন পল্লীর বিদ্যুৎ বিলের দ্বায় পৌরসভা নেবে না। তারা ব্যয় করলে তারা বিল দেবে। সেখানে নতুন করে নামে নামে প্রিপেইড মিটার লাগিয়ে দিতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগকে। হরিজনদের কাজের বিনিময়ে নির্দিষ্ট বেতন দেয়া হয়। বাইরে কাজ করেও তারা উপার্জন করেন। কাজেই তাদের যথেচ্ছা বিদ্যুৎ ব্যবহারের টাকা আর বহন করবে না পৌরসভা। এ ব্যাপারে এখন থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগকে।