মুক্তেশ্বরী নদকে মুক্ত করার তাগিদ
যশোরের মুক্তেশ্বরী নদীর ওপর অপরিকল্পিতভাবে ব্রিজ ও স্লুইসগেট নির্মাণ ও মাছ ধরার জন্য অবৈধভাবে দখল করে বাঁধ দেয়া হয়েছে। এ কারণে জোয়ার-ভাটা বাধগ্রস্ত হয়ে নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। পানি প্রবাহ না থাকায় নদীটি এখন মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে। কোথাও কোথাও বিলীন হয়েছে যশোরের ঐতিহ্যের অংশ এই নদটি। দখলদার, নাগরিক অনীহা এবং সরকারি নির্দেশ যথাযথ বাস্তবায়ন না করায় এই নদীটি মানচিত্রে থাকলেও বাস্তব থেকে হারিয়ে যাওয়ার পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।
মুক্তেশ্বরী টেকা নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোর জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ৪০ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৪২ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা “পাউবো” কর্তৃক মুক্তেশ্বরী টেকা নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী নং ৭৩।
যশোরের চৌগাছা উপজেলার জগদীশপুর বাওড়ের পাশ দিয়ে সলুয়া বাজার সংলগ্ন এলাকা হয়ে সদর উপজেলার আরবপুর ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে নদীটি। সেখান থেকে নদীটি মণিরামপুর হয়ে সাতক্ষীরার কলারোয়া গিয়ে মিশেছে।
সরেজমিন যশোর সদর উপজেলার আরবপুর ইউনিয়ন পরিষদ ভবনসংলগ্ন এলাকা, মণ্ডলগাতি, পুলেরহাট অংশ ঘুরে দেখা গেছে, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দখলদাররা ভবন নির্মাণ, ময়লা ফেলার ভাগাড় ও মাছ চাষসহ নানা কাজে ব্যবহার করছেন। কোথাও কোথাও নদীর দুই পাশ দখল করে সরু করা হয়েছে। কোথাও স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। আবার কোথাও নেটপাটা ও বাঁশের বেড়া দিয়ে নদীর প্রবাহ আটকে মাছ চাষ করছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। নদীর প্রকৃত সীমানা যেমন চিহ্নিত নেই, তেমনি কে কোথায় কতটুকু দখলে নিয়েছে তারও পুরোপুরি হিসাব কেউ দিতে পারেননি। ফলে এক সময়ের প্রবাহমান নদীটি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
পুলেরহাট এলাকার এক চা দোকানদার বলেন, এক সময় নদীতে স্রোত ছিল। নদীপাড়ের লোকজন নানা অজুহাতে তা দখল করেছে। এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিনেও খনন কিংবা নদী সংরক্ষণে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে নদীটি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, প্রভাবশালীরা নদী দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। কিন্তু নদীরক্ষার দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এজন্য নদী দখলে কেউ পিছিয়ে নেই। যার যতটুকু সুযোগ আছে, সে ততটুকু দখল করে বসে আছে।
নাম প্রকাশ না করে আরবপুর ইউনিয়ন পরিষদ ভবনসংলগ্ন এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, নেটপাটা দিয়ে নদীর পানি প্রবাহ আটকে রেখে মাছ চাষ করছে এলাকার কতিপয় ব্যক্তি। তারা জালিয়াতির মাধ্যমে এটিকে খাল দেখিয়ে ডিসি অফিস থেকে লিজ নিয়েছিল। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে লিজ বাতিল করে ডিসি অফিস। কিন্তু আজও অবৈধ নেটপাটা রয়ে গেছে। এভাবেই মাছ চাষ চলছে। এলাকার মানুষ পানিতেও নামতে পারে না। ওইসব প্রভাবশালীরা পানিতে নামলেই মারধর করে।
স্থানীয়রা আরও জানান, স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় নদী মরা খালে পরিণত হয়েছে। ছোট ছোট খাল হিসেবে যে যার মতো দখল করেছেন। অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ ও খনন ছাড়া নদীকে বাঁচানো সম্ভব নয়।
যশোরের সমাজসেবীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মূলত নদীটা যাদের দেখার কথা, সেই কর্তৃপক্ষ দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। অনৈতিক সুযোগ নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখল করার সুযোগ দিয়ে থাকে।
নদী সংরক্ষণ আইন আছে, তবে সুষ্ঠু প্রয়োগ হয় না। এজন্য শুধু মুক্তেশ্বরী নয়; যশোরের অনেকেই নদীই আজ দখল হয়ে রয়েছে। নদীগুলো মারা যাওয়ার ফলে পরিবেশ, চাষাবাদ ও জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসলেও কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে না বসায় কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী কোন মন্তব্য করেননি।
মুক্তেশ্বরী নদীর উৎপত্তিস্থল থেকে সাতক্ষীরার কলারোয়ার খর্নিয়া পর্যন্ত খনন ও দখলমুক্ত করার জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। প্রকল্প পাস হলেই নদী রক্ষার কাজ শুরু হবে।
নদীতে ভেসে আসা আবর্জনা ও কচুরিপানার স্তূপ জমে গেছে। জমে থাকা এসব কচুরিপানা পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। মশা জন্ম নিচ্ছে। ফলে নদীর তীরবর্তী স্থানের মানুষের বসবাস কষ্টকর হয়ে উঠছে। পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে। জলজ জীববৈচিত্র্যের টিকে থাকাও কঠিন হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় মানুষ নদীটিকে বাঁচাতে কচুরিপানা ও মাছ ধরার অবৈধ বাঁধ অপসারণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছে। নদীতে প্রবাহমান স্রোত ধারার থাকবে। সেখানে কচুরিপানা জমে থাকার কথা নয়।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মুক্তেশ্বরী নদীতে কচুরিপানা জমে রয়েছে। বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে নদীটি। শুধু মুক্তেশ্বরী নদী নয়, দেশের অনেক নদ-নদীই বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। যেগুলোতে নেই কোনো পানি প্রবাহ। কোথাও বা কচুরিপানার স্তূপ জমেছে। আবার কোথাও জমেছে মানুষের ফেলা আবর্জনা। ফলে নদী তার প্রবাহ হারিয়ে বদ্ধ জলাশয়ের আকার ধারণ করেছে। আর এজন্যই দেশের অনেক নদ-নদী অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।
দেশের অনেক নদ-নদী প্রভাবশালী চক্র দখলও করে নেয়। যেমনটি ঘটেছে যশোরের মুক্তেশ্বরী নদীর ক্ষেত্রে। মাছ ধরার জন্য নদীটিতে বাঁধ দিয়েছে স্থানীয় অনেক ব্যক্তি। কিন্তু এটা দেখার কেউ নেই। দখল ও দূষণে একটি নদীর প্রবাহ থেমে গেলো কিন্তু কেউ প্রতিকারের জন্য এগিয়ে এলো না।
মুক্তেশ্বরী নদী থেকে আবর্জনা ও কচুরিপানা অবসারণের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু যশোরের মুক্তেশ্বরী নদীই নয়, দেশের যে সব নদী বর্জ্য ও দখলে বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে, সেসব নদী উদ্ধার ও সংস্কার করতে হবে। দখল ও বর্জ্যমুক্ত হলেই নদীর প্রণোচ্ছলতা ফিরে আসবে।