মাসে বেচাকেনা ১০ কোটি টাকা কুটিরশিল্প গ্রাম আলতাপোল কর্ন্দপপুর মঙ্গলকোট ও বড়েঙ্গা
মালিক উজ জামান, যশোর : আলতাপোল, কন্দর্পপুর, বড়েঙ্গা ও মঙ্গলকোটকে বলা হয় কুটিরশিল্পের গ্রাম। এসব গ্রামের কারখানায় ঘূর্ণমান কাঠের টুকরায় বাটালির ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে বাহারি ফুলদানি, মোমদানি, কলমদানি, পাউডার কেস, খুনতি, হামাম, কিংবা রুটি বেলা বেলুন।
যশোর জেলার মহাকবি মাইকেলের প্রিয় জন্মভূমি কেশবপুরর আলতাপোল, কন্দর্পপুর, বড়েঙ্গা ও মঙ্গলকোটে এসব কুটিরশিল্প অবস্থিত। উপজেলার এ চার গ্রামের অন্তত: ৫০০ পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছেন কাঠ শিল্পের ছোঁয়ায়। কুটিরশিল্পের এসব জিনিস থেকে চার গ্রামে গড়ে প্রতি মাসে বেচাকেনা হয় প্রায় ১০ কোটি টাকা। কুটিরশিল্প মালিকরা জানান, এক যুগ আগে গ্রাম গুলোর বেশির ভাগ মানুষ কাজের অভাবে জীবিকা নির্বাহে হিমশিম খেত। এখন সেই তারাই সারা দিন থাকেন কর্মমুখর। নিজেদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার পাশাপাশি এসব গ্রামে এসেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। তবে সরকারি সহযোগিতা পেলে আরও সমৃদ্ধ হতে পারবেন বলে আশা করছেন শিল্পীরা।
জানা যায়, নব্বই দশকের শুরুতে কেশবপুর উপজেলার আলতাপোল গ্রামের ইনসার আলী ভারত থেকে শিখে এসে কাঠের কাজ শুরু করেন। অল্প দিনেই সফলতার মুখ দেখেন তিনি। সেই শুরু। তার এই সাফল্যে উদ্ধুদ্ধ হয়ে এ কাজে সম্পৃক্ত হন আলতাপোল, কন্দর্পপুর, বড়েঙ্গা ও মঙ্গলকোটসহ আশপাশের কয়েক গ্রামের অনেকেই।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের পল্লী জীবিকায়ন প্রকল্পের আওতায় এ চার গ্রামকে ‘শিল্পপলীø’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। বাড়ি বাড়ি বিদ্যুৎ পৌঁছে যাওয়ায় কেশবপুরের এ কুটিরশিল্প এখন চার গ্রাম ডিঙ্গিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের গ্রামেও। প্রতি পরিবারের নারী-পুরুষ, এমনকি শিশুরাও এখন কাঠের শিল্পে পারদর্শী। নারীরা নিয়মিত এ কাজে যুক্ত হওয়ায় আয় বেড়েছে পরিবারের। বর্তমানে ওই চার গ্রামে রয়েছে এ রকম অন্তত ৪০০ কারখানা। এসব কারখানায় মালিক-শ্রমিক ও কাঠ ব্যবসায়ী মিলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কমপক্ষে ২০,০০০ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছেন।
আলতাপোল গ্রামের বাসিন্দা কারখানা মালিক সাধন কুমার রায় জানান, এক যুগ আগেও অন্যের জমিতে কামলা খাটতেন তিনি। গ্রামের ইনসার আলীর দেখাদেখি শুরু করেন কাঠের ব্যবসা। নিজ বাড়িতে একটি কারখানা স্থাপন করেন। পরে মেহগনি কাঠ থেকে মোমদানি, ফুলদানি, কলমদানি, বাটি, পাউডার কেস, বয়াম, ডিম সেট, আপেল সেট, খুনতি, হামাম, পিঁড়ি, মেয়েদের চুড়ি রাখার আলনা, হারিকেন, পেনসিল, অ্যাশট্রে, সিদুর বক্স, ধামাপাতি, খয়েরদানি, টিফিন বক্সসহ নানা ধরনের শোপিস তৈরি করতে থাকেন। তিনি আরও জানান, প্রথমে স্থানীয় বাজারে এগুলো বিক্রি শুরু করলেও পরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, কুষ্টিয়া, বাগেরহাট, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অর্ডার আসতে শুরু করে। বর্তমানে তার কারখানায় ৫০ জন শ্রমিক কাজ করেন। প্রতি মাসে তার ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা বেচাকেনা হয় বলে জানান তিনি।
কাঠ শ্রমিক উজ্জল কুমার দাস জানান, মূলত এসব জিনিসপত্র তৈরির উপাদান ক্ষুদ্র মেহগনিকাঠ। প্রথমে আমাদের মহাজন স-মিল থেকে কাঠ কেটে নিয়ে আসেন। কাঠ কেটে কাঠের ছাল ওঠানো হয়। সেখান থেকে কাঠ শুকানো হয় দুই থেকে তিন দিন। তারপর কারখানা এনে বিদ্যুৎচালিত মটরের চাকায় লাগিয়ে ঘূর্ণমান কাঠের টুকরোতে বাটালির ছোঁয়ায় তৈরি করি নানা রকমের পণ্য। পরে রং করে রোদে শুকায়ে মহাজনের কাছে বুঝিয়ে দিই। মহাজন আমাদের পিস হিসেবেই মজুরি দেয়।
ভাই ভাই কুটিরশিল্পের শ্রমিক তন্ময় রায় জানান, প্রতিদিন ভোর থেকে কাজ শুরু হয়। দুপুরে ঘণ্টাখানেক বিরতি দিয়ে কাজ শেষ করি সন্ধ্যায়। আট ইঞ্চি হামাম বানালে আমাদের মজুরি দেয় ৩০ টাকা, ৪ ইঞ্চি বানালে ৪ টাকা, ৭ ইঞ্চ বানালে ১৫ টাকা করে দেয়। সব মিলিয়ে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি ওঠে। প্রতিদিন সব মিলিয়ে ৫০ থেকে ৬০টি তৈজসপত্র তৈরি করতে পারেন শ্রমিক সফিউল। তিনি জানান, গড়ে দিনে ৬০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয় তাদের। এ কাজ করে ভালোভাবেই সংসার চলছে তাদের। কাঠশিল্পী কামরুল ইসলাম জানান, কেশবপুরে এ রকম চার শতাধিক কারখানা গড়ে উঠেছে বাড়িতে বাড়িতে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ কাজে যুক্ত রয়েছে কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষ। কেশবপুরের গ্রামে তৈরি এসব কাঠের সামগ্রী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। পাইকাররা বাড়ি এসে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। ভাই ভাই কুঠির শিল্পের স্বত্বাধিকারী কবির হোসেন জানান, বেশ আগে থেকেই এ কাজ শুরু হলেও এর ব্যাপকতা লাভ করে এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ-সংযোগ আসার পর। তার অধীনে অর্ধশতাধিক শ্রমিক কাজ করছেন। অনেক শ্রমিক মাসিক বেতনে কাজ করলেও অনেকে কাজ হিসেবে টাকা নিয়ে থাকেন। সব খরচ বাদ দিয়ে মাসে অর্ধলক্ষ টাকা লাভ থাকে তার।
ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম জানান, কেশবপুরে উপজেলার চার গ্রামের ৫০০ পরিবার সদস্য এই কুঠির শিল্পে স্বাবলম্বী হয়েছে। কুঠির শিল্পের এসকল জিনিসপত্র কেনাবেচায় মাসে প্রায় ১০ কোটি টাকা লেনদেন হয় গ্রাম চারটিতে। এক সময় এসব গ্রামের মানুষ কাজের অভাবে দিন কাটাতো। এখন কেউ বেকার বসে থাকে না। সবাই কোনো না কোনোভাবে এ কুটিরশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। দিন-রাত এসব কারখানায় কাজ হয়। এখানে অনেক নারী শ্রমিকও কাজ করছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তাদের তৈরি কাঠের পণ্য বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব। এতে এ শিল্প আরও ব্যাপকতা লাভ করবে।
কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম আরাফাত হোসেন বলেন, বংশ পরম্পরায় এত গুলো পরিবার এই পেশায় জড়িত। গ্রামগুলোকে একেকটি কারখানা মনে হয়। ইতিমধ্যে বিআরডিবির পল্লী জীবিকায়ন প্রকল্পের আওতায় গ্রামগুলোকে শিল্পপল্লি হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের উন্নত প্রশিক্ষণ, ঋণদান কর্মসূচিসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে অর্থসহায়তা, প্রশিক্ষণ ও বাজারের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করে দেওয়া হবে। প্রত্যেকে পাবেন পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ সহায়তা।