জে. জাহেদ, চট্টগ্রাম প্রতিনিধিঃ
চট্টগ্রাম কর্ণফুলী উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির খুঁটি হলো পাঁচ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ শাখা। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের সেই খুঁটির অবস্থা এখন নড়বড়ে। গত ৮ বছর ২ মাস ১৬ দিন অতিবাহিত হলেও নামকেওয়াস্তে একটি ইউনিয়নে সম্মেলন হলেও এখনো পাঁচ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের কমিটি দিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মো. সোলায়মান তালুকদার।
একাধিকবার ঘোষণা দিয়েও দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ওই পাঁচ ইউনিয়নে কমিটি গঠন করতে পারেননি। কমিটিতে জায়গা পেতে আগ্রহী নেতাকর্মীরা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে দৌড়ঝাঁপ করে কমিটি গঠনের বিষয়ে জানতে চেয়েও কোনো উত্তর পাচ্ছেন না। ইতোমধ্যে উপজেলা আওয়ামী লীগ কতৃক ঘোষিত ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কমিটি নিয়েও নেতারা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ও হতাশার মধ্যে রয়েছেন।
জানা যায়, গত ২০১৬ সালের ৮ মার্চ কর্ণফুলী থানার পাঁচ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিলো। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তখন সম্মেলন করতে না পারায় তৎকালিন ভূমিপ্রতিমন্ত্রীর পরামর্শে কমিটি ঘোষণা করেছিলেন থানা শাখার সভাপতি সৈয়দ জামাল আহমদ (বর্তমানে প্রয়াত) ও সাধারণ সম্পাদক হায়দার আলী রনি।
তখন শিকলবাহা ইউনিয়নে দিদারুল ইসলাম চৌধুরী কে সভাপতি ও আবদুল করিম ফোরকান কে সাধারণ সম্পাদক, চরপাথরঘাটায় সৈয়দ আহমদ সভাপতি ও জসিম উদ্দিন সাধারণ সম্পাদক, চরলক্ষ্যায় রফিক আহমদ সভাপতি ও মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ সাধারণ সম্পাদক, জুলধায় আমির আহমদ সভাপতি ও রফিক আহমদ সাধারণ সম্পাদক এবং বড়উঠানে আমজাদ হোসেন সভাপতি ও আবদুল মান্নান খান কে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের কেউ আর পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেননি।
বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থার খোঁজ খবর নিলে জানা যায়, ২০২২ সালের ১৬ নভেম্বর শিকলবাহা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি দিদারুল ইসলাম চৌধুরী দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সভাপতি নির্বাচিত হলে শূণ্য হয়ে যায় সভাপতি পদ। ফলে, এক নেতা বিশিষ্ট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগে পরিণত হয় শিকলবাহা। সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম ফোরকান নিজেই ইউনিয়ন নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হলেও ভরাডুবি হন। দলের সাংগঠনিক দুরাবস্থা ও জনসমর্থন না থাকার কারণে।
অন্যদিকে, কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রচারণা করায় ২০২২ সালের ২৯ অক্টোবর চরপাথরঘাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ আহমেদ কে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সৈয়দ আহমেদ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মোহাম্মদ আলীর ছোট ভাই হন। বহিষ্কার হলেও এখন আবার আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় হাজির হচ্ছেন। এরপূর্বে সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন দুরারোগ্য রোগে মারা গেলে তারস্থলে কামাল আহমেদ রাজাকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
২০২৩ সালের ১৭ মার্চ শাহমীরপুর বাদামতল (পিএবি) সড়কের পাশে বড়উঠান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বড়উঠান ইউনিয়ন সম্মেলনে সভাপতি পদে প্রার্থী হন মোহাম্মদ নাজিম, আবদুল মান্নান খান। আজিম উদ্দিন সাগর সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হন। এরপর উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠিত হলে তাতে দপ্তর সম্পাদক হন বড়উঠান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আমজাদ হোসেন। কিন্তু এখনো বড়উঠান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সম্পাদক দাবি করছেন আমজাদ-আব্দুল মন্নান খান।
চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিক আহমদ কে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি করা হয়। কিন্তু একই ব্যক্তি আবার বর্তমান ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি। এই ইউনিয়নে ৮ বছর ধরে মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঝুলে রয়েছেন।
জুলধা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আমির আহমদ মাঝখানে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
অন্যদিকে, জুলধার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান রফিক আহমদ ৮ বছর যাবৎ সম্পাদক হিসেবেই রয়েছেন।
এভাবে পাঁচ ইউনিয়নে ৮ বছর ধরে পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় ইউনিয়ন ইউনিয়নে নানা কোন্দলে জর্জরিত তৃণমূল। একের পর এক ওয়ার্ডে পকেট কমিটি হলেও তাও দেখেনি কোন আলোর মুখ। ইউনিয়নে পূর্নাঙ্গ কমিটি না থাকায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। গেল উপজেলা নির্বাচনেও পড়েছে এর প্রভাব। নেই দলের চেইন অব কমান্ড।
বিভক্ত তৃণমূল নেতাকর্মীরা ফারুক-সোলায়মান পরিষদের কর্মকাণ্ডে অনেকটা হতাশ। নির্বাচন এলেই নৌকার একের পর এক পরাজয় ঘটে। দুর্বল হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাটিও। যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে টানা চারবার ক্ষমতায় থেকেও ইউনিয়নে মাঠ গোছাতে ব্যর্থ হচ্ছেন কর্ণফুলী উপজেলা আওয়ামী লীগ।
কোন রকমে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সভাপতি-সম্পাদক দিয়ে চলছে জোড়াতালিতে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম। কোন ইউনিয়নে ৮ বছর আগের সাধারণ সম্পাদক আছে, সভাপতি নেই। আবার গুটিকয়েক ইউনিয়নে সম্মেলন করে ইউনিয়ন কমিটি বিলুপ্ত হলেও সভাপতি-সম্পাদক বহাল তবিয়তে দিব্যি দাবি করছেন তাঁরা আবারো সভাপতি সম্পাদক। শুধু তাই নয়, কমিটির মেয়াদ চলে গেলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে মাথাব্যথা নেই উপজেলা আওয়ামী লীগের। দলটির সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনসহ বিভিন্ন ইউনিটেও বিরাজ করছে একই পরিস্থিতি।
এতে দীর্ঘ হচ্ছে কমিটিতে স্থান পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষায় থাকা নেতাকর্মীদের সারি। অনেকের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে চাপা ক্ষোভ ও হতাশা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সব স্তরেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার কোন উদ্যোগ নেই উপজেলা নেতাদের। এর অভ্যন্তরে রয়েছে শীর্ষ নেতাদের দ্বন্দ্ব, স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম, বিতর্কিত ও হাইব্রিডদের নাম আসায় কমিটি গঠনে বড় অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে বলে মন্তব্য পদবঞ্চিত অনেক নেতাদের।
তাঁদের মতে, দলের জন্য নিবেদিত, রাজনীতিতে অভিজ্ঞ নেতাদের উপেক্ষা করে পছন্দের নেতাদের দিয়ে ‘পকেট কমিটি’ গঠনের চেষ্টা করছেন সংশ্লিষ্ট নেতারা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ ত্যাগীদের কমিটিতে স্থান দিতে নির্দেশ দেন। কিন্তু তাতেও কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। বঞ্চিতরা হতাশ হয়ে পড়েছে।
এ প্রসঙ্গে কর্ণফুলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোলায়মান তালুকদার বলেন,’ আমরা পাঁচ ইউনিয়নে যে ওয়ার্ড কমিটি গুলো দিয়েছি। এসব কমিটির নেতাকর্মীদের সাথে সামনে বসবো। তাঁরপর আমাদের রাজনৈতিক অভিভাবক সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপির সাথে পরামর্শ করে শিগগিরই পাঁচ ইউনিয়নে পূর্নাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করব।’
সভাপতি ফারুক চৌধুরী’র মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও ফোন রিসিভ না করায় কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নজরুল ইসলাম টুকু বলেন,’সম্মেলনের সব ধরনের প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে। ইতিমধ্যে বড়উঠান ইউনিয়নে সম্মেলন হয়েছে। শিগগরই বাকি চার ইউনিয়নেও করা হবে। তারঁপর দলকে গতিশীল করার লক্ষে নতুন নেতৃত্বে আনতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে। কমিটিতে যাঁরাই আসবেন সবাইকে নিয়ে মিলে মিশে কাজ করব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপির হাতকে শক্তিশালী করতে।’
ওয়ার্ড কমিটি কেন উপজেলা ঘোষণা করেছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘সেটা গঠনতন্ত্র সম্মত নয়। সেটা সকলে জানেন। কারণ ওয়ার্ড কমিটি গঠন করবেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ। কিন্তু আমাদের তো ইউনিয়ন কমিটি পূর্নাঙ্গ ছিলো না। তবুও এ বিষয়ে সভাপতি-সম্পাদক ভালো বলতে পারবেন।’
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হায়দার আলী রনি বলেন,’ আমি সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে পাঁচ ইউনিয়নে যে কমিটি দিয়েছিলাম সেটি এখনো চলছে। বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদক এখনো নতুন করে কমিটি দিতে পারেনি। শোনেছি চেষ্টা করতেছে হয়তো টাইমিং হচ্ছে না। আমি তো এখন জেলায় চলে আসলাম। তাই এ বিষয়ে আমি কোন মন্তব্য করতে পারছি না।’