শীর্ষ নিউজ

বিদেশে চিকিৎসার ব্যয় হয় বছরে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার : ডিসিসিআই সেমিনারের তথ্য

 

ঢাকা, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস): ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, বিদেশে স্বাস্থ্যসেবা নিতে প্রতিবছর আমাদের ব্যয় হচ্ছে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। আজ রাজধানীর ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত ‘স্বাস্থ্য খাতে বিদেশমুখিতা কমাতে দেশীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি’  বিষয়ক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।

সেমিনারে নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি’র সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান বলেন, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার স্বল্পতা, চিকিৎসা ব্যবস্থায় আস্থার ঘটতি, সর্বোপরি সাচ্ছন্দ্য সেবার অভাবে অসংখ্য লোক দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। এগুলো যথাযথভাবে চিহ্নিত করে, সমাধানের মাধ্যমে রোগীদের বিদেশমুখীতা হ্রাস করা সম্ভব।

দেশে পরিচালিত ল্যাবরেটরিগুলোর মান উন্নয়ন, বাজেট সহায়তা বাড়ানোর মাধ্যমে চিকিৎসাশাস্ত্রের গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধি ও বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলকে শক্তিশালী করার উপর গুরুত্ব আরোপ করে অধ্যাপক এ কে আজাদ বলেন, প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চিকিৎসা বিজ্ঞান একটি সদা পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া। এমতাবস্থায় বর্তমানে আমরা যা কিছু প্রত্যক্ষ করছি, আগামী ২৫ বছর পর এক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। তাই সেরা প্রযুক্তিগত অগ্রগতি গ্রহণ করার জন্য একটি সঠিক পাঠ্যক্রম থাকা জরুরী।

স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, ডব্লিউটিও’র তথ্য মতে বাংলাদেশের ৪৯ শতাংশ মানুষ মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা পায়না। সেই সাথে স্থানীয় সেবায় প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক মান না থাকায় বিদেশে স্বাস্থ্য সেবা নেওয়ার প্রবণতা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডিসিসিআই সভাপতি এই খাতের উন্নয়নে বিশেষকরে উন্নত অবকাঠামো ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা, বাজেট সহায়তা বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক  হাসপাতলসমূহের চেইন কার্যক্রম বাংলাদেশে চালু করা, বিদেশী ডাক্তার ও নার্সদের বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনার রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সহজ করা, স্বাস্থ্যখাতের সকল ধরনের লাইসেন্স প্রাপ্তি ও নবায়নের প্রক্রিয়াগত জটিলতা নিরসন এবং ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রবর্তনসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেসরকারিখাতে হাসপাতাল কার্যক্রম চালুকে উৎসাহিত করতে ‘কর অব্যাহতি’ সুবিধা প্রদানের উপর জোর দেন ।

আশরফ আহমেদ বলেন, সাম্প্রতিককালে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোও  ক্রমবর্ধমান হারে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছে, যদিও অনেক চিকিৎসাই স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায়। রোবোটিক সার্জারির মতো চিকিৎসা সেবা স্থানীয়ভাবে পাওয়া সম্ভব হলেও,  তুলনামূলকভাবে কম আত্মবিশ্বাস এবং গ্রাহকদের সন্তুষ্টির অভাবে হয়তো বিদ্যমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে, গ্রাহক সন্তুষ্টি কেবল চিকিৎসা থেকে আসে না, বরং পুরো হাসপাতালের ইকো-সিস্টেম যথা: নার্স, প্রশাসন, টেকনোলোজি সব কিছুই এর সাথে সম্পৃক্ত। মানের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য বিদেশী ডাক্তার, নার্স ও টেকনোলজিস দেশে আসার প্রক্রিয়া আরো সহজতর করতে হবে।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের মাথাপিছু ব্যয় ১১০ মার্কিন ডলার, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে ব্যয় হয় ৪০১ মার্কিন ডলার। তিনি বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল ৩০ হাজার ১২৫ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের মাত্র ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ।  প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতার কারণে দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী বিশ্বের অন্যান্য দেশের সেবা নিয়ে থাকে এবং ২০১২ সালে বিদেশে স্বাস্থ্য সেবা নেওয়ায় বাংলাদেশীদের ব্যয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশে ৫ হাজার ৪৬১ টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে, যার মধ্যে ১ হাজার ৮১০ টি ঢাকা বিভাগে অবস্থিত। পাশাপাশি ৩৬টি স্পেশালাইজড হাসপাতালের মধ্যে ১৯টি ঢাকা’তে অবস্থিত হওয়ায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী লোকজন উন্নত স্বাস্থ্য সেবা হতে বঞ্চিত হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত ঢাকার উপর চাপ বাড়ছে। তিনি উন্নত স্বাস্থ্য সেবার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে অবকাঠমোর স্বল্পতা, দক্ষ ডাক্তার, নার্স ও টেকনিশিয়ান-এর অভাব, সরকারী হাসপাতলে সেবা প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা, উন্নত সেবার জন্য ইন্স্যুরেন্স কভারেজের ব্যবস্থা না থাকা প্রভৃতি অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।

বিদ্যমান অবস্থা উত্তরণে স্বাস্থ্য খাতের রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ার সহজ করা, সরকারিভাবে সকলের জন্য স্বাস্থ্য সেবা ইন্স্যুরেন্সের আওতায় নিয়ে আসা, স্বাস্থ্য খাতে বাজেট সহায়তা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, পিপিপি মডেলে ঢাকায় আন্তর্জাতিক হাসপাতালসমূহের কার্যক্রম শুরু, সহায়ক নীতি সহায়তা প্রদানের উপরও  জোর দেওয়ার কথা বলেন মালিক তালহা ইসমাইল বারী।

সেমিনারে বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল’র ভারপ্রাপ্ত রেজিস্টার ডা. মো. লিয়াকত হোসাইন, বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক ওনার্স এসোসিয়েশনের ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি এবং সমরিতা হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এ বি এম হারুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব হেলথ ইকোনোমিক্স’র প্রাক্তন পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আব্দুল হামিদ, বিএসএমএমইউ’র স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিসিয়ান্স অ্যান্ড সার্জন্স’র সেক্রেটারি ডা. আবুল বাসার মো: জামাল এবং বাংলাদেশ সোসাইটি অব ইমার্জেন্সি মেডিসিন’র সেক্রেটারি জেনারেল ডা. মীর সাদউদ্দিন আহমেদ অংশগ্রহণ করেন।

বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল’র ভারপ্রাপ্ত রেজিস্টার ডা. মো. লিয়াকত হোসাইন বলেন, বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা একটি কার্যকর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারি, যার মাধ্যমে বিদেশ যাওয়ার প্রবনতা কমানোর  পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করে রিজার্ভ বৃদ্ধি সম্ভব। উন্নত সেবা প্রদানে রোগীদের প্রতি ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিকতা পরিবর্তন একান্ত অপরিহার্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশীয় ডাক্তার ও নার্সদের দক্ষতা উন্নয়নের আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট স্থাপনের কোন বিকল্প নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব হেলথ ইকোনোমিক্স’র প্রাক্তন পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিদ্রুত একটি মেডিকেল অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। এছাড়াও তিনি শুধুমাত্র স্বাস্থ্য প্রশাসনকে দক্ষতার সাথে পরিচালনার জন্য সিভিল সার্ভিস থেকে বাদ দিয়ে পৃথক স্বাস্থ্য ক্যাডারের প্রস্তাব করেন পাশাপাশি এ খাতকে আরও কার্যকর করতে জুডিশিয়ারি সার্ভিস কমিশনের মতো স্বাস্থ্যসেবা কমিশন গঠনের উপর জোর দেন। বিএসএমএমইউ’র  স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, আস্থা এই সেক্টরের উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাই আমাদের স্বাস্থ্যসেবাকে স্বাস্থ্যসেবা পর্যটনে রূপান্তর করতে হবে। বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে উন্নত স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের লক্ষ্যে গ্রামীণ পর্যায়ে আরো বেশি ভালোমানের হাসপাতাল স্থাপন করা উচিত বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিসিয়ান্স অ্যান্ড সার্জন্স’র সেক্রেটারি ডা. আবুল বাসার মো. জামাল বলেন, বাংলাদেশ এখন ওষুধ উৎপাদনকারী দেশ এবং আমরা বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও করি, কিন্তু চিকিৎসা যন্ত্র উৎপাদনে আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। এমতাবস্থায় এ খাতে আরো ভালো করতে হলে দক্ষ জনশক্তি ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে। তিনি জানান, বাংলাদেশে ১ লাখ ৩৪ হাজার চিকিৎসক রয়েছেন এবং এর মধ্যে মাত্র ৩৩ হাজার সরকারি চিকিৎসক।

তবে এটা সন্তোষজনক যে এখানে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১০ হাজারের বেশি বিদেশি মেডিকেল শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব ইমার্জেন্সি মেডিসিন’র সেক্রেটারি জেনারেল ডা. মীর সাদউদ্দিন আহমেদ বলেন, কোভিডের সময় কেউ চিকিৎসা নিতে বিদেশে যায়নি। মহামারীর সেই সময়ে আমরা পরিস্থিতি সামলাতে পেরেছি, এটা স্বাস্থ্যসেবা খাতে আমাদের সক্ষমতা প্রতিফলিত করে। তিনি বিশ্বমানের ডাক্তারদের সাথে প্ল্যাটফর্ম বাড়াতে এবং আস্থা তৈরির সুবিধার উপর জোরারোপ করেন।

ঢাকা চেম্বারের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ সহ সংশ্লিষ্ট বেসরকারিখাতের প্রতিনিধিবৃন্দ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button