শিশুদের সুরক্ষায় স্থানীয় সরকারের ভূমিকা

৫ মার্চ, ২০২৫ (বাসস): রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া শানু বেগমের (১৪) বাবা চার বছর আগে মারা গেছেন। শানু বলেন, ‘আমরা চার ভাইবোন। তিনবোন স্কুলে পড়ি। ভাই ও মা বিভিন্ন ধরনের কাজ করেও ঠিকভাবে আমাদের পড়ালেখা ও সংসার চালাতে পারতো না। আমার মা বিধবা ভাতাও পেতো না। এ রকম অবস্থায় আমি আমার স্কুলের শিক্ষকদের সহায়তায় ইউনিয়ন পরিষদের কাছে মায়ের বিধবা ভাতার জন্য আবেদন করি। ছয়মাস হলো আমার মা এই ভাতা পাচ্ছেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে শিশুদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবশ্যই শিশুদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এ জন্য তারাও নানাভাবে কাজ করতে পারে। শিশুরাই আগামী দিনে নেতৃত্ব দেবে। এ জন্য তাদের পড়ালেখার পাশাপাশি কিছু গঠনমূলক কাজের চর্চা প্রয়োজন। তাদের সুযোগ দিতে হবে, শেখাতে হবে এবং গড়ে তুলতে হবে। এমনই ধারণা নিয়ে সেভ দ্যা চিলড্রেন, বাংলাদেশ কিছু কার্যক্রম (যেমন চাইল্ড ফ্রেন্ডলি লোকাল গভর্নেন্স) পরিচালনা করছে।
প্রতিষ্ঠানটির শিশু সুরক্ষা কার্যক্রমের পরিচালক আবদুল্লা আল মামুন বলেন, ‘সাতক্ষীরার কয়েকটি উপজেলায় আমরা স্থানীয় সরকারের সহযোগিতা নিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছি। এতে একেকটি ইউনিয়নের স্থানীয় শিশু-কিশোরদের একটি দল গঠন করে তাদের মাধ্যমে কাজ করছি। ইউনিয়ন পরিষদের মাসিক সভা কিংবা ওয়ার্ড সভায় শিশুরা তাদের সমস্যাগুলো তুলে ধরে। যেগুলোর তাৎক্ষণিক সমাধান সম্ভব সেগুলোর সমাধান করা হয় এবং যেগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বা উন্নয়ন প্রয়োজন সেগুলোর সমাধান সেভাবে করা হয়। যেমন কেউ হয়তো ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে, কারো বাল্যবিবাহ হচ্ছে বা তারা যে রাস্তা দিয়ে স্কুল যাচ্ছে সেটা হয়তো জলাবদ্ধতায় ভরে গেছে কিংবা কোনো রাস্তায় হয়তো বাতি নেই, স্কুলে ভর্তির টাকা নেই, নিরাপদ পানি, স্কুলে বেঞ্চ বা নলকূপ প্রয়োজন ইত্যাদি।
এগুলোর সমাধান স্থানীয় সরকার সহজে করতে পারছে। আবার দেখা যাচ্ছে, তারা যে রাস্তা দিয়ে স্কুলে যাচ্ছে সেটা হয়তো খুবই খারাপ, কোথাও হয়তো সেতুর সমস্যা, তাদের মধ্যে কেউ হয়তো প্রতিবন্ধী কিন্তত্ম সে প্রতিবন্ধী ভাতা পায় না, কারো মা বিধবা বা তার অন্য কোনো সমস্যা আছে ইত্যাদি। যেগুলোর তাৎক্ষণিক সমাধান সম্ভব নয়। এগুলোর জন্য উন্নয়ন, পরিকল্পনা এবং সময় প্রয়োজন। এগুলোর জন্য স্থানীয় সরকার সময় নিয়ে কাজগুলো করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শিশুদের সাথে কথা বলে সেভাবে তাদেরকে তৈরি করি বা গাইড করি। ফলে তারা তাদের সমস্যাগুলো খুব সহজভাবে দৃঢ়তার সাথে তুলে ধরতে পারে। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরাও সাধ্যমতো কাজগুলো করার চেষ্টা করছে। উপজেলা প্রশাসনও তাদেরকে সহযোগিতা করছে। শিশুদের কাছে ইউএনও এবং থানার নম্বর রয়েছে। প্রয়োজনে তারা তাদেরকে ফোন করে। এই কাজের অভিজ্ঞতা আমাদের কাছে অনেক ইতিবাচক। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আমাদের এই অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে দেশের অন্যান্য উপজেলাগুলোতে কাজ করতে পারে। এতে শিশুরা শুধু জিপিএ ৫-এর পিছনে না ছুটে এ ধরনের কাজের মাধ্যমে নিজেদের অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনগুলো শিখতে পারে। এগুলো তাদের ব্যবহারিক ক্লাসের মতো, যা দেশ ও জাতি গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে।’
শিশুদের সুরক্ষায় স্থানীয় সরকার নানাভাবে কাজ করছে বলে জানান মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের সাবেক প্রকল্প পরিচালক ড. আবুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘শিশুদের স্থানীয় থানা, ওসি, ইউএনও’র ফোন নম্বরসহ জরুরি ৩৩৩, ৯৯৯ এবং ১০৯ নম্বরগুলো জানা থাকা এবং এগুলোর কার্যকারিতা সম্পর্কে ধারণা থাকলে আরও সুফল পাওয়া যাবে। ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেকশন থেকে লিফটলেটের মাধ্যমে এগুলো জানানো যায়।’
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় জানায়, ‘সারাদেশে সরকারের এ ধরনের কার্যক্রম রয়েছে। স্থানীয় সরকারের মূল কাজ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা। এরমধ্যে শিশুদের সমস্যাগুলোও পড়ে। বাল্যবিবাহ, ধর্ষণ, যৌতুক, ইভটিজিং, রাস্তাঘাটের সমস্যা ইত্যাদি মোকাবিলা করার জন্য ইউনিয়নগুলোতে বিভিন্ন সভা, গ্রাম আদালত, মোবাইল কোর্ট, গণশুনানীর ব্যবস্থা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে যেমন আইনগত বিষয়গুলো রয়েছে, তেমনি এগুলোর মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরি হয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে এবং কিছু কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠী সংস্থা বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবে সরকারের সাথে কাজ করলে সমাজ আরও এগিয়ে যাবে এবং দেশ ও জাতি গঠন সহজতর হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।