হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন। তিনি ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিবও। বর্তমানে ভারতের জি২০ বিষয়ক প্রধান সমন্বয়ক। তাঁর নয়াদিল্লির দপ্তরে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি।
প্রশ্ন : বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা : আমরা সন্তুষ্টির সঙ্গে বলতে পারি, এই সম্পর্কটি আজ সবচেয়ে জোরালো। এই সম্পর্ক দুই দেশের জন্যই একটি শক্তি। বিশ্বের যেকোনো জায়গায় এখন দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সহযোগিতার প্রতীক বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক। লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যদি দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সহযোগিতার আদর্শ দেখতে চায়, তাহলে তারা আমাদের দেখতে পারে। তারা দেখতে পারে, আমরা একে অন্যকে কীভাবে সহযোগিতা করছি। কীভাবে সম্ভাবনাগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করছি। এটি এমন এক সম্পর্ক, যা সবার নিবিড়ভাবে অধ্যয়ন করা উচিত। আর এটা আমরা গত ১০ বছরে অর্জন করেছি।
প্রশ্ন : তাহলে গত ১০ বছরে কোন বিষয়গুলো বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে ‘প্রতীকে’ রূপান্তর করেছে?
হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা : গত ৫০ বছরে আমরা অনেক দূর এগিয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে গত ১০ বছরে। এখন আমরা বলি, আমাদের সম্পর্কের ‘সোনালি অধ্যায়’ চলছে। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আমাদের দুই দেশের মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল, তা ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিশেষ প্রচেষ্টা চালানো আছে।
পঁচাত্তরপূর্ববর্তী সম্পর্কের চেয়ে আজ আমাদের সম্পর্কের পার্থক্য হলো, আমাদের প্রতিটি খাতেই বহুমুখী অংশীদারি আছে। এতে দুই দেশ, দুই দেশের জনগণ লাভবান হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে সংযোগ বাড়ছে। ভারত থেকে বাংলাদেশে উচ্চগতির ডিজেল সঞ্চালন লাইন যাচ্ছে। বিদ্যুৎ যাচ্ছে। একে অন্যকে ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দিচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলো, দুই দেশের মনোভাবে অনেক পরিবর্তন এসেছে।
প্রশ্ন : অভিন্ন নদ-নদীর পানিবণ্টনের বিষয়গুলোর সমাধান তো দ্রুত হচ্ছে না।
হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা : কুশিয়ারা নদীর পানি নিয়ে এবার সমঝোতা হয়েছে। এটি একটি অগ্রগতি। যৌথ বিবৃতিতে আরো নদ-নদী নিয়ে কাজ করার কথা বলা হয়েছে। আমি মনে করি, পানির ক্ষেত্রে সহযোগিতা শুধু বণ্টন নয়, তথ্য আদান-প্রদান, দূষণ ও নাব্যতার দৃষ্টি থেকেও দেখা উচিত। এখানে আরও কিছু বিষয় আছে। অভিন্ন ৫৪টি নদ-নদী নিয়েই আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
প্রশ্ন : ভবিষ্যতের বাংলাদেশের সরকারগুলোর কাছে ভারতের প্রত্যাশা কী থাকবে?
হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা : নিকটবর্তী প্রতিবেশীর যেকোনো অস্থিতিশীলতা ভারতের ওপর প্রভাব ফেলবে। আবার ভারতে অস্থিরতা হলে আপনাদের ওপর প্রভাব ফেলবে। তাই আমি মনে করি, আমাদের দুই দেশের উগ্রবাদ, সন্ত্রাসবাদ, স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করা দরকার। আমি স্বাভাবিক রাজনৈতিক শক্তিগুলোর কথা বলছি না, ধ্বংসাত্মক অপশক্তিগুলোর কথা বলছি।
যেমন- শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সন্ত্রাসের বিরূদ্ধে তাঁর কোনো ধরনের ছাড় না দেওয়ার নীতি আছে। আমরা তাঁর সরকারের সময় স্থল সীমান্ত চুক্তি, সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পেরেছি। বাংলাদেশের জন্য ভারত বড় উন্নয়ন সহযোগিতা দিয়েছে।
শান্তি, স্থিতিশীলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের আবার এমন পরিস্থিতি আসতে দেওয়া উচিত নয়, যাতে আমরা বিবাদ, উগ্রবাদ ও বিভক্তিতে জড়াই। কোনো পর্যায় থেকেই এটি সমর্থন করা উচিত নয়।
প্রশ্ন : বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমারে সংঘাত চলছে। রাখাইন রাজ্যে আগে থেকেই সমস্যা ছিল। আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য এটি কতটা ঝুঁকি সৃষ্টি করছে?
হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা : মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্ত আছে। দুই দেশের সঙ্গেই আমাদের ভালো সম্পর্ক। আমাদের অংশীদারদের নিয়ে যা যা করা সম্ভব, আমরা করব।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি পক্ষ বিভিন্ন সময় ভারতের নিরপেক্ষ ভূমিকা প্রত্যাশা করে—এ বিষয়ে কী বলবেন?
হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা : ভারতের পররাষ্ট্রনীতির মূল বিষয় হলো, অন্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা। ভারত এটিই অনুশীলন করে আসছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার অবস্থান থেকে বলছি, অন্য দেশের রাজনৈতিক ইস্যুতে জড়ানোর পরিকল্পনা ভারতের থাকবে না। একজন নাগরিক হিসেবেও আমি মনে করি না, ভারত এমনটি করতে চায় বা করেছে।
প্রশ্ন : আপনি ভারতের জি২০ বিষয়ক প্রধান সমন্বয়ক। জি২০-এর সভাপতি হিসেবে ভারতের লক্ষ্য কী?
হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা : ভারত প্রথমবারের মতো জি২০-এর সভাপতির দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে। জি২০ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর জোট। উন্নত ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো এর সদস্য। আমার দৃষ্টিতে, জি২০-এর সভাপতি হওয়া ভারতের জন্য একটি অনন্য সুযোগ। এটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতকে তার ব্যাবহারিক এজেন্ডা উপস্থাপন করার সুযোগ করে দেবে।
প্রশ্ন : ভারত এমন সময় জি২০-এর সভাপতির দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে, যখন ইউক্রেন-রাশিয়াসহ নানা সংকটে বিশ্বে অস্থিরতা চলছে। এই পরিস্থিতিতে জি২০-এর সভাপতি হিসেবে ভূমিকা রাখতে ভারত কতটা প্রস্তুত?
হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা : অন্য অনেক দেশের মতো ভারতও সংকট সমাধানের তাগিদ দিচ্ছে। সংঘাতের অবসান হওয়া উচিত। কূটনীতি ও সংলাপের ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সমাধান হওয়া উচিত।