চট্টগ্রামশীর্ষ নিউজ

খুলশী ফ্ল্যাটে গৃহকর্মী খুন: তিন মাস পর মা বাদি!


চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:

চট্টগ্রাম খুলশী এলাকায় এক চেয়ারম্যান পূত্রের ফ্ল্যাটে গৃহকর্মী আমেনা খাতুন (১৪) হত্যা মামলায় বাদি পরিবর্তনের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। সিএমপি খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা ও মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) মো. নুরুল আবছার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তদন্তকারী কর্মকর্তা আরও জানান, ‘গৃহকর্মী হত্যা মামলাটির শুরুতেই বাদি ছিলেন ফ্ল্যাটের মালিক মো. সাইফুল ইসলাম (৩২)। কিন্তু ৩ মাস ৯ দিন পর তাঁকে আদালতের নির্দেশে বাদ দিয়ে নতুন করে বাদি করা হয়েছে খুন হওয়া গৃহকর্মীর মা আঁখি আক্তার (৪১) কে।’

গত ২৬ জুলাই চট্টগ্রামের চীফ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্টেট আদালত আঁখি আক্তারকে ওই মামলার বাদি হিসেবে গণ্য করার আদেশ প্রার্থনা করেন বাদি পক্ষের আইনজীবি।

গত ৯ আগস্ট (বুধবার) চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরিফুল ইসলামের আদালতে বাদী পরিবর্তনের এই আবেদনের উপর দীর্ঘ শুনানি শেষে গৃহকর্মী আমেনা বেগমের মা আঁখি আক্তারকে মামলার বাদী হিসেবে অন্তর্ভুক্তি করার নির্দেশ দেন। যা মুঠোফোনে নিশ্চিত করেন বাদি পক্ষের আইনজীবি মোহাম্মদ গোলাম মাওলা মুরাদ।

বাদি পক্ষের এই আইনজীবি আদালতে আবেদনে জানান, ‘ভিকটিমের মা ঘটনার সময় ওমানে কর্মরত ছিলেন। তাই নিজ মেয়ে খুনের মামলায় বাদি হতে পারে নাই। গত ৩০ মে তিনি দীর্ঘ ১ বছর পর বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে মেয়ের হ্ত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জানতে পারেন। তাঁর মেয়ে আমেনা খাতুন কে হত্যা বা খুন করার পর পুলিশকে প্রভাবিত করে যিনি ভিকটিমকে খুন করেন, তিনিই মিথ্যা মামলা সাজিয়ে মামলার বাদি হন। অর্থ্যাৎ খুনি নিজেই মামলার বাদি। যাতে মামলা তদন্তে প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া যায়। পাশাপাশি পুলিশ ভিকটিমের কোন আত্মীয়কে বাদি না করে ভুল করেন।’

আর্জি সূত্রে আরও জানা যায়, ‘এমন কি গত ০৪ জুন ভিকটিমের মাকে বাদি করতে চীফ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এর আগেও বাদি পরিবর্তনের আবেদন করেন আঁখির আইনজীবি বাবুল দাশ। কিন্তু আদালত বিনা মন্তব্যে আবেদনটি খুলশী থানার মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রেরণ করেন। এবং ভিকটিমের মা একাধিকবার তদন্ত কর্মকর্তার সাথে দেখা করে যোগাযোগ করলেও বাদি করা যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন। বিষয়টি খুলশী থানার ওসিকে জানালেও তিনিও কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেননি। হয়তোবা, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মামলার পূর্ববর্তী বাদির নিকট থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন। তাই ভিকটিমের মাকে বাদি করতে রাজি ছিলেন না।’ পরে আইনজীবি পুনরায় বিষয়টি বিজ্ঞ আদালতের নজরে আনলে বাদি পরিবর্তনের নির্দেশ দেন।

জানা যায়, গত ১৭ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৮ টায় দক্ষিণ খুলশীর ২ নম্বর রোডের ১০১ নং র‍্যাংগস এফসি বাড়ির বি-৬ ফ্ল্যাট থেকে গৃহকর্মী আমেনা খাতুনের লাশ উদ্ধার করেন পুলিশ। আর ওই ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজী ছাবের আহমদ এর বড় ছেলে মো. সাইফুল ইসলাম (৩২)। এজাহারে তিনি একজন মৎস্য ব্যবসায়ি বলে জানান।

নিহত আমেনা খাতুনের বাড়ি রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পদুয়া দ্বারিকোপ মুন্সীর বাড়ী। পিতা মৃত হাফিজুল রহমান। মাতা আঁখি আক্তার। আমেনা খাতুন ওই বাসায় গৃহকর্মীর কাজ শুরু করেন নিহত হওয়ার মাত্র আড়াই মাস আগে। আমেনা খুন হওয়ার পর দিন রাতেই ফ্ল্যাটের মালিক সাইফুল ইসলাম নিজেই বাদী হয়ে খুলশী থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। খুলশী থানার মামলা নম্বর-২২(০৪)২৩ ইং। জিআর মামলা নং-১৫৩/২৩ ইং।

ওই এজাহারে বাদি সাইফুল ইসলাম (৩২) জানান, গত ১৫ জানুয়ারি নিহত আমেনা খাতুন তাঁর বাসায় বেতনভুক্ত গৃহকর্মী নিযুক্ত ছিলেন। আমেনার মা ওমান প্রবাসী। ঘটনায় জড়িত আসামি সোহিদুল ইসলাম ফাহিম (২০) এর বাড়ী ফ্ল্যাট মালিক সাইফুলের একই এলাকায়। সে গত ২ বছর যাবত এ বাসায় কাজ করেন। ঘটনার রাতে ১৭ এপ্রিল গৃহকর্তার পরিবারের সবাই রমজানের সেহেরী খেয়ে ভোর ৫ টার দিকে ঘুমাতে যান।

পরের দিন সকাল অনুমান সাড়ে ৮ টার দিকে বিল্ডিংয়ের ইলেকট্রিশিয়ান মো. সামী গৃহকর্তা সাইফুলের মোবাইল ফোনে কল দিয়ে জানান, বাসার গৃহকর্মী আমেনা খাতুন ৬ তলা থেকে ব্যালকনি দিয়ে পড়ে দ্বিতীয় তলার সানশিটের উপর রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ইলেকট্রিশিয়ান আরও জানান, ঘটনার সময় পালানোর চেষ্টাকালে অপর গৃহকর্মী ফাহিমকে আবাসিক এলাকার মুখ থেকে স্থানীয়রা আটক করে রেখেছেন। গৃহকর্তা এ কথা শোনে বিল্ডিংয়ের নিচে নেমে এসে দেখে গৃহকর্মী আমেনা গুরুতর আহত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে।

স্থানীয় লোকজনের সামনে অপর গৃহকর্মী মো. ফাহিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, ফাহিম ভিকটিম আমেনা খাতুন (১৪) কে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেন। বিষয়টি আমেনা পুলিশকে জানাবে বললে, বিবাদী ফাহিম ভিকটিমকে হত্যার উদ্দেশ্যে গলা চেপে ধরলে আমেনা অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পরে জ্ঞান ফিরলে ভিকটিমকে বাসার ব্যালকনি দিয়ে নিচে ফেলে দেন। এ সময় গৃহকর্মী আমেনা বিল্ডিংয়ের ৬ তলা থেকে দ্বিতীয় তলার সানশিটে উপর পড়ে রক্তাক্ত জখম হন।

ওখান থেকে ভিকটিমকে উদ্ধার করে চটগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠালে কর্তব্যরত চিকিৎসক গৃহকর্মী আমেনাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। এমনকি মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিকিৎসকরা সনদপত্রে (BROUGHT IN DEAD TO FALL FROM HEIGHT) উঁচু জায়গা থেকে পড়ে মৃত্যু হয়েছে বলে জানান।

খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা তৎসময়ে জানিয়েছিলেন, ‘কাজের ছেলে কাজের মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা করে, না পেরে ব্যালকনি দিয়ে বাহিরে ফেলে দেন। এ ঘটনায় অভিযুক্ত আসামীকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। আদালতে তিনি জবানবন্দীও দিয়েছেন।’

আদালতে দেওয়া জবানবন্দীতে সোহিদুল ইসলাম ফাহিম বলেন, ‘আমি আর আমেনা একই বাসায় কাজ করতাম। আমাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সে বিয়ে করতে চাইলে আমি রাজি হইনি। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে বিরোধ হয়। আমরা ঘনিষ্ঠ সময় পার করি কিন্তু সেক্স করিনি। বিয়ে করতে বলায় ঝগড়া হয়। এক পর্যায়ে গলা চেপে ধরলে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। পরে ৬ তলা থেকে ফেলে দিই।’ রহস্য এখানেই ফাহিম বলল ‘সেক্স করেনি’ তাহলে এজাহারে লিখা রয়েছে ধর্ষণ করা হয়েছে। তাহলে কে গৃহকর্মী আমেনা কে ধর্ষণ করল?

ওদিকে, চেয়ারম্যান পুত্র তাঁর দায়ের করা এজাহারে ধর্ষণের কথা উল্লেখ করলেও পুলিশ বলছেন ভিন্ন কথা। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার পূর্বের বাদী ও ফ্ল্যাটের মালিক মো. সাইফুল ইসলাম তখন জানান, ‘আমার বক্তব্য মামলার এজাহারে উল্লেখ রয়েছে। ওই সময় মেয়েটির কোন অভিভাবক না থাকায় ভিকটিমের মায়ের ইচ্ছায় আমি মামলা করেছি ও বাদি হয়েছি।’

কিন্তু সর্বশেষ বাদি আঁখি আক্তার বলেন,‘আমার মেয়েকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে। এতে ফ্ল্যাট মালিক কখনো বাদি হতে পারে না। ঘটনার সময় আমার রক্তের সম্পর্কের অন্য আত্মীয়রা উপস্থিত হয়েছিলেন। কিন্তু কাউকে বাদি করা হয়নি। এছাড়াও আমি বিদেশ থেকে আসার পর প্রকৃত ঘটনা জানতে ফ্ল্যাট মালিক সাইফুলকে একাধিকবার কল করেছি। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। বাসায় গেলেও দেখা করেননি। এছাড়া এজাহারেও নানা অসঙ্গতি দেখতেছি। থানা পুলিশ বোবা হয়ে গেছে। আমাকে বাদি করতে তারা কিছুতেই রাজি ছিলো না। পরে বাদি করতে বাধ্য হয়েছে। আমি আদালতে এর ন্যায় বিচার চাইবো। এ মামলাটি অধিকতর তদন্ত করা প্রয়োজন।’

একই ঘটনার প্রেক্ষিতে সদরঘাট এলাকার সুমি আক্তার (৩১) বলেন, ‘চেয়ারম্যান পুত্র সাইফুলের বাসায় আমার ছোট বোনকেও গৃহকর্মী হিসেবে দিয়েছিলাম। কিন্তু গত ২৭ মার্চ বিকেল সাড়ে ৪ টার দিকে বোনের বেতনের টাকার জন্য গেলে আমাকেও হঠাৎ গালিগালাজ করে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। এর দুইদিন পর আমি সাইফুলের স্ত্রী মিম আক্তার, সাইফুল ও আরমানের নামে খুলশী থানায় জিডি করেছিলাম। যার সাধারণ ডায়েরি নম্বর-২৩৮৮। তখনকার জিডি তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সুমন বড়ুয়া শাপলা সব ঘটনার সত্যতা পেয়েছিলেন।’

জানতে চাইলে বাদির আইনজীবি মোহাম্মদ গোলাম মাওলা মুরাদ বলেন, ‘গৃহকর্মী আমেনা খাতুন হত্যা মামলায় তাঁর আপন মাকে বাদি করতে পুলিশ তিন মাস যাবত গড়িমসি করেছেন। যা রহস্যজনক। এমনকি যার বাসায় গৃহকর্মী খুন হলেন, তিনি কি করে মামলার বাদি হন। ভিকটিমের আত্মীয় স্বজনকে কেন বাদি করা হয়নি। আবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কিছুতেই ভিকটিমের মাকে বাদি করতে রাজি ছিলেন না। উনাকে আদালত থেকে বারবার বলার পরও আমলে নেননি। পরে তাঁকে আদালত শোকজ করেন এবং সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারায়, আদালত নির্দেশ দেন ভিকটিমের মাকে বাদি করার ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button