রাজনীতিশীর্ষ নিউজ

দেশের রাজনীতির ইতিহাস সত্যনিষ্ঠ ও নৈর্ব্যক্তিকভাবে রচনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে: বদরুদ্দীন উমর

 

২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, লেখক-গবেষক ও ইতিহাসবিদ বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, দেশের রাজনীতির ইতিহাস সত্যনিষ্ঠ ও নৈর্ব্যক্তিকভাবে রচনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ জন্য তিনি নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা’র (বাসস) কাছে সম্প্রতি দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ আহবান জানান।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের মৌলিক গবেষণা গ্রন্থের রচয়িতা বদরুদ্দীন উমর দীর্ঘ ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় তুলে ধরেন। একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন সম্পর্কে তাঁর অভিব্যক্তি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন ৭৩ বছর আগে হয়েছিল। সেই থেকে এই আন্দোলনের ওপর আলোচনা হয়েছে, বলা চলে টুকরো টুকরো আলোচনা, কিন্তু বাংলাদেশ আমলের আগে পাকিস্তানি আমলে এই আন্দোলনের ওপর উল্লেখযোগ্য কোন কাজই হয়নি। প্রত্যেক ফেব্রুয়ারি মাসে শোনা যেত আবেগ-উচ্ছাসপূর্ণ আলোচনা। তবে তখনকার দিনে একটা জিনিস ছিল খুব ভালো, প্রত্যেক বছর ২১ ফেব্রুয়ারি এটি প্রতিবাদ দিবস হিসেবে পালিত হতো। সকালে যে অনুষ্ঠান হতো সেটাও খুব ভালো, সেই প্রভাতফেরিতে  গান গেয়ে গেয়ে সব অল্প বয়সের লোক তার সাথে কিছু মধ্য বয়সের লোকরা ভোরবেলা খালি পায়ে রাস্তায় বের হতো।

বদরুদ্দীন উমর বলেন, তখন যেভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হতো ৭১ সালের পরে সেটা সম্পূর্ণভাবে পাল্টে গেল। খুব চাতুর্যের সাথে শেখ মুজিব প্রতিবাদের দিবসটিকে শোক দিবসে পরিণত করলো। এ জন্য তিনি নিজেই ১৯৭২ সালের বিশে ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার সময় শহিদ মিনারে উপস্থিত হয়ে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করলেন। এরফলে যেটা হলো ৭২ সালেই প্রভাতফেরি উঠে গেল। এই যে- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি… গান গেয়ে মানুষ শহিদ মিনারে আসতো সেটা শেষ হয়ে গেল। তারপর থেকে ভাষা আন্দোলন যে একটি প্রতিবাদ দিবস হিসেবে উদযাপিত হতো সেটা আর থাকলো না। দিনটি একটি শোক দিবস হিসেবে পালিত হতে শুরু করলো।

একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিলেন,তাদের স্মৃতিতো আমরা বেদনার সাথে ধারণ করি, শ্রদ্ধা জানাই। এ প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমর বলেন, এই দিবসটিতে শোকের কি আছে? তার চেয়ে বড় হলো বিদ্রোহ-প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। আমি বলতাম এটি প্রতিরোধের দিবস, শেখ মুজিব খুব চাতুর্যের সাথে এটিকে জাতির সামনে একটি শোক দিবসে পরিণত করলেন। তিনি যে অপকর্ম ও অপকৃতির দিকে যাচ্ছেন, এতে তার শাসন আমলেও একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দিবসে পরিণত হতে পারে, সেটা তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন। সেই জন্য প্রতিবাদকে শোকে পরিণত করেন।

বদরুদ্দীন উমর বলেন, সেই থেকে দেখা যায় এদেশে যতো আন্দোলন হয়েছে, একুশে ফেব্রুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসে কোন বড় আন্দোলন হতে দেখা যায়নি। এখন যে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হয়, সাধারণভাবে এটি একটি রিচ্যুয়াল বা রীতি হিসেবে পালিত হচ্ছে। আর একটা কথা হচ্ছে,বাংলাভাষা নিয়ে এখনো অশ্রুপাত করা হয়, এতো বছর পরেও বাংলা ভাষা সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত হলো না, হয়ওনি এখনো। যেভাবে বাংলাভাষার প্রচলন, পরিচর্যা উন্নতি হওয়ার দরকার ছিল, সে রকম কিছু হয়নি। উপরন্তু নতুন প্রজন্ম ইংরেজির দিকে ঝুঁকেছে, বাংলাভাষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, আমাদের দেশে অসংখ্য ভালো ছাত্র আছে যারা বাংলা জানে না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছে তারা বাংলা জানে না এটা বলতে গর্ববোধ করে। এই রকম জাতি মনে হয় বাঙালি ছাড়া দুনিয়াতে আর কেউ নেই। ৭৩ বছর পরে ভাষা দিবস পালিত হতে থাকলেও সেই আন্দোলনের প্রতি আগে মানুষের যে সত্যিকার আবেগ ছিল, এই আন্দোলনের কথা মানুষ আগে যেভাবে স্মরণ করতো, সেটা আজকাল আর নেই। বরং হাসিনার আমলে ফ্যাসিজমের মধ্যে সেই আন্দোলনকে একেবারেই শেষ করা হয়েছে। হাসিনার বিদায়ের পর এই প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হতে যাচ্ছে, কিন্তু এই একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের মধ্যে কোন পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার মাত্র এক বছরের মধ্যেই ভাষার প্রশ্নে আন্দোলন শুরু হলো-এর মাধ্যমে শুরুতেই দেশটির সংহতিতে ফাটল ধরলো। কোন প্রেক্ষাপটে এই অন্দোলন শুরু হলো এই প্রশ্নে বদরুদ্দীন উমর বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অল্পদিনের মধ্যেই পূর্ববঙ্গের ভাষার প্রশ্ন সামনে এসেছিল। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ-বাঙালিদের একটা জাতীয়তা আছে, তার ভিত্তি হচ্ছে ভাষা।
এখানে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলেই দীর্ঘকাল ধরে এই ভাষার পরিচর্যা করেছে। পাকিস্তান তৈরি হওয়ার সময় বলা হয়নি যে পাকিস্তান একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র হবে। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর বলা হতে থাকলো যে পাকিস্তান একটি ইসলামি রাষ্ট্র। এটি লাহোর প্রস্তাবেও ছিলো না,পাকিস্তান আন্দোলনের সময়েও এটা বলা হয়নি, এটা ইসলামি রাষ্ট্র হবে, জিন্নাহ সাহেবও বলেননি। জিন্নাহ সাহেবের সাথে তো প্রাকটিসিং ইসলামের কোন সম্পর্ক ছিলো না। গান্ধীর সাথে যেমন বিভিন্ন কাস্টের সম্পর্ক ছিল, তিনি হিন্দুত্ব প্রচার করেছেন। জিন্নাহ’র সাথে তেমন কিছু ছিলো না।

পাকিস্তান হওয়ার পর এমন দাঁড়ালো যে এটি একটি ইসলামি রাষ্ট্র। আগস্টে পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই জুলাই মাসে কি  হতে যাচ্ছে এমন ধারণা থেকেই পূর্ববঙ্গে দাবি উঠলো এই নতুন রাষ্ট্র হবে অসাম্প্রদায়িক। ঢাকাতে তাজউদ্দিন আহমেদ, কামরুদ্দীন আহমদ এবং অলি আহাদের নেতৃত্বে গঠিত হলো গণ আজাদী লীগ-তারা বললেন আগামীতে এই দেশে একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করতে হবে। অন্যদিকে পাকিস্তানের দুই অংশ পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভাষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে, আন্দোলনগত ঐতিহ্যের দিক থেকে, সামাজিক আচরণগত দিক থেকে কোন ঐক্যই  ছিলো না। এমন কি পশ্চিম পাকিস্তানিরা যেভাবে ইসলামের চর্চা করতো, পূর্ব বাংলায় ইসলামের প্রাকটিস অন্যরকম। তবু মোটাদাগে এই দুই অঞ্চলের মধ্যে একটি বড় বন্ধন ছিল ইসলামের। এ জন্য দুই অংশ নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হলো।

প্রথম থেকেই তারা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য ইসলামের ওপর নির্ভর করতো এবং তারা বললো, এই দেশ একটি ইসলামি রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে তারা সেটা ইসলামের বিরুদ্ধতা বলে প্রচার করতো। যেমন দেখা গেল হাসিনার সময়, তার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললেই সেটাকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা বলা হতো। এই ধরণের শয়তানি আগেও ছিল।

বদরুদ্দীন উমর বলেন,পাকিস্তানকে ইসলামি রাষ্ট্র বলা ছিল সেই রকমই একটা অবস্থা। পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলিম লীগের মধ্যে যে প্রগতিশীল বামপন্থ’ী অংশ ছিল মুসলিম লীগের ডানপন্থী অংশ তাদেরকে মুসলিম লীগে ঢুকতেই দেয়নি। এটা ছিল বড় মূর্খতার কাজ। এটি এখানকার প্রাদেশিক পরিষদের নেতাদের মূর্খতা। দেশের তখনকার বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এই বামপন্থ’ী অংশ বিরুদ্ধ অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেল। তারাই আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় ছিল,তারাই ভাষাকে অবলম্বন করে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুললো। এটা বুঝতে পেরে আন্দোলন-সংগ্রাম রোধ করার জন্য পাকিস্তানীরা প্রথম ১৯৪৮ সালেই বললো এখানে উর্দুই একমাত্র ভাষা হবে। লক্ষ্যণীয় বিষয়, উর্দু ভাষা ইসলামি ভাষা, এটার কোন ভিত্তি নেই। উর্দু এমন একটা ভাষা যা পাকিস্তানের কোন অংশেরই ভাষা নয়। শুধু বাংলা নয়,উর্দু পাঞ্জাব,সিন্ধ,সীমান্ত প্রদেশ,বেলুচিস্তান কোন এলাকারই ভাষা নয়। উর্দু হচ্ছে ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশের ভাষা। উর্দু একটি ভারতীয় ভাষা। তাহলে পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানের কোন ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা না করে একটি ভারতীয় ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করা হলো, ভারতের অভিজাত মুসলিমদের ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা করা হলো। যারা ভারত থেকে পাকিস্তানে গেল তাদের ভাষা। পাকিস্তানের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তারা সব তো পাকিস্তানী নয়, সেখানে ইন্ডিয়ান ছিলেন। জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, চৌধুরী খালিকুজ্জামান এরা সবাই ইন্ডিয়ান।

রাষ্ট্র ভাষা নিয়ে এ সময় ভারতেরও সমস্যা তৈরি হয়েছিল। কংগ্রেস হিন্দীকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দিয়েছিল-এর প্রতিবাদও হয়েছিল। ভারত কিভাবে এটি মোকাবিলা করেছিল, এ প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমর বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের কিছুদিন পরে দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ, মাদ্রাজ,তামিলনাড়ু, কেরালায় এবং আসামে হিন্দী ভাষার প্রবল বিরোধীতা দেখা দিল। তারা হিন্দীর পক্ষে না, অথচ কংগ্রেস হিন্দীকে ভারতের রাষ্ট্রীয় ভাষা করে রেখেছে। এই বিরোধে কোথাও কোথাও গোলাগুলিও হয়েছিল। কিন্তু নেহেরু বুদ্ধিমান লোক ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এসব অঞ্চলে বিরোধিতা শুরু হলে সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে। হিন্দী ভাষা হিসেবেও অগ্রসর নয়, উর্দু যেমন একটা অগ্রসর ভাষা তেমন নয়, বাংলা একটা অগ্রসর ভাষা কিন্তু হিন্দী তখন তেমন অগ্রসর ভাষা ছিলো না। পূর্ব পাকিস্তানে একটা প্রদেশই ছিল, একটি ভাষার লোক ছিল, ভারতে তেমন নয়, সেখানে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের আলাদা ভাষা এবং এক অঞ্চলের ভাষার লোক অন্য অঞ্চলেও ছিল। তখন নেহেরু একই ভাষার লোকদের নিয়ে ভারতের প্রদেশগুলোকে ভাষার ভিত্তিতে পুনর্বিন্যাস করেন। নেহেরু এভাবে ভাষা সমস্যার সমাধান করেন। ভাষা সমস্যাকে তিনি ক্রিটিক্যাল জায়গায় যেতে দেননি। শুধু আসামে ঝামেলা হয়েছিল, পরে সেটাও মিটমাট হয়ে গেছে।

ভাষা আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকায় কারা ছিলেন-এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সালে। এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তমুদ্দুন মজলিস। এটিই সবচেয়ে সংগঠিত গ্রুপ ছিল। এর সকলেই ভাষা আন্দোলনে বড় ভূমিকা রেখেছেন। তাদের সৈনিক পত্রিকা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রেখেছে। পরে ১৯৫২ সালের আন্দোলনে তাদের সে অবস্থা থাকেনি। এ সময়ে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন এসেছিল। গ্রুপিং তৈরি হয়েছিল। এ সময়ে আন্দোলনে আওয়ামী লীগের তেমন কোন ভূমিকা ছিল না, তবে বামপন্থী প্রভাবিত যুবলীগের সক্রিয় ভূমিকা ছিল।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় বদরুদ্দীন উমরের বয়স ছিল ২১ বছর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। এই আন্দোলনের তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী। সেই সময়ের অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলনের প্রত্যেকটি ঘটনায় আমি দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। আমি কোন নেতা কিংবা কর্মীও ছিলাম না। আমি জীবনে কোন ছাত্র সংগঠনে কাজ করিনি। ১৯৬৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের আগে কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও যুক্ত ছিলাম না। আমি ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন ঘটনার সময় যে উপস্থিত থাকতাম, সেটা ব্যক্তিগতভাবে একজন অবলোকনকারী হিসেবে ছিলাম। এই থাকা আমার কাজে এসেছিল, যখন ভাষা আন্দোলন নিয়ে বই লিখলাম। আমি চোখের সামনে দেখেছি কারা কি কাজ করছে। সেই আন্দোলনে আমার কোন ভূমিকা ছিলো না। সাধারণ ছাত্র হিসেবে বিভিন্ন ঘটনা দেখেছি। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ঘেরাওয়ের সময়, বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করার সময় এবং পরে মেডিকেল কলেজ সব জায়গায় উপস্থিত ছিলাম। মিছিলেও যোগ দিয়েছি।

ভাষা আন্দোলনে তখনকার রাজনৈতিক দলের ভূমিকা কেমন ছিল-এ বিষয়ে তিনি বলেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন কোন রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিলো না। আন্দোলনের কোন পরিচালকও ছিলো না। তবে ছাত্রদের যে আন্দোলন গড়ে উঠতে লাগলো এতে যুবলীগের যে ভূমিকা ছিল, সে তুলনায় আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা ছিল না। তবে এটা বলা যাবে না এ আন্দোলন যুবলীগের নেতৃত্বে হয়েছে, তারা এই আন্দোলনের সাথে ছিল। তখন যুবলীগের সেক্রেটারি অলি আহাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।

ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের ভূমিকা প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমর বলেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের কোন ভূমিকা ছিলো না। শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা গলা ফাটিয়ে সব সময়েই বলে আসছেন, শেখ মুজিবই নাকি ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এমনকি এখানকার এক লেখিকা, উপন্যাসিক পত্রিকায় লিখলো ‘বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন’। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু কিভাবে এলো। চামচামার্কা লোকজন এসব বলে বেড়াচ্ছে। সম্পূর্ণ মিথ্যাকে তারা সত্য হিসেবে তুলে ধরছে। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি জেলে ছিলেন, ১৭ ফেব্রুয়ারি তাকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে পাঠানো হয়। ফরিদপুর থেকে তিনি কিভাবে নেতৃত্ব দেবেন। শেখ মুজিব নিজেও মিথ্যা কথা বলতেন। তিনি বলেছেন, তিনি নাকি ওয়াশরুমের জানালা দিয়ে চিরকুট লিখে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতেন। একদম মিথ্যা কথা, একুশে ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকায় ছিলেন না। গত বছরও হাসিনা বলেছে, ভাষা আন্দোলনের জন্য তার বাবা বারবার জেলে গেছে, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এটা ঠিক শেখ মুজিব বারবার জেলে গেছেন,  তিনি অনেক রকম আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং সেসব কারণে জেলে গেছেন। কিন্তু মিথ্যা কখনো টিকে থাকে না। সত্য প্রকাশ পাবেই। সত্য প্রথমে উঁকি দেয়, আমি বলবো আমার লেখায় সত্য উঁকি দিয়েছে এবং এখন সত্য প্রকাশ্যে এসেছে। ইতিহাসকে কেউ ধামাচাপা দিয়ে রাখতে পারে না। কারণ যারা ক্ষমতায় থাকে তারা চিরকাল ক্ষমতায় থাকতে পারে না।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে বিকৃতি ও  মিথ্যাচারের অভিযোগ রয়েছে। জাতি হিসেবে এটি আত্মঘাতি। এর থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কি? এ বিষয়ে দেশের বরেণ্য এই ইতিহাসবিদ বলেন, শেখ মুজিবের শুধু ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা নিয়ে নয়, এ দেশের ইতিহাস যেভাবে বিকৃত করা হয়েছে, আওয়ামী লীগই একটা অর্গানাইজেশন যারা প্রথম ‘ইতিহাস বিকৃতকরণ’ বলে একটা কথা চালু করেছে, এর আগে আমরা কখনো শুনিনি। তারাই এটা চালু করলো এবং তাদের চেয়ে বেশী ইতিহাসের বিকৃতকরণ আর কেঊ করেনি। তারাই ইতিহাস চর্চাকে একদম শেষ করে ফেলেছে। কাজেই শুধু শেখ মুজিবের ভূমিকা নয়, এ দেশের রাজনীতির ইতিহাস সত্যনিষ্ঠ, নৈর্ব্যক্তিকভাবে রচনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আশা করা যায় যে, নতুন প্রজন্ম সামনে সেই দায়িত্ব পালন করবে।

ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ- প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭১ সালে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। কিন্তু এই স্বাধীনতা হচ্ছে শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, দুনিয়ার মানচিত্রে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ। কিন্তু জনগণের প্রাপ্তির দিক থেকে দেখা যাবে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কোন প্রাপ্তি নেই। এমনকি বাংলাদেশ হওয়ার পর শেখ মুজিবের যে আওয়ামী শাসন তৈরি হলো, সাড়ে তিন বছরে জনগণ কিছুই পায়নি। শুধু শোষণ, নির্যাতন, রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার, নির্মমতা, দুর্ভিক্ষ এসব পেয়েছে। বলা যাবে না শেখ মুজিবের আমলে জনগণ কানাকড়িও পেয়েছে। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, শেখ মুজিবকে যখন ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হলো তখন তার জন্য রাস্তায় একটা মানুষও দাঁড়ায়নি। কেউ শোক প্রকাশ করেনি। উপরন্তু হাজার হাজার লোক রাস্তায় বেরিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছিল। মিষ্টি বিতরণ করেছিল। অথচ এই শেখ মুজিবকে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে এই দেশের জনগণ, লাখ লাখ মানুষ তাকে সংবর্ধনা জানিয়েছিল। অনেক ভালোবেসে ছিল । সাড়ে তিন বছরের মাথায় তাকে যখন হত্যা করা হলো, একটা লোকও রাস্তায় বেরিয়ে এলো না। কারণ কি? এটা তো ব্যাখ্যা করতে হবে, আওয়ামী লীগকে ব্যাখ্যা করতে হবে, শেখ মুজিবের বেটিকে ব্যাখ্যা করতে হবে।

জনগণের এই যে প্রতিক্রিয়া, যেমন এখনো যা দেখা যাচ্ছে ৫ আগস্টে হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্তভাবে চারদিক থেকে মানুষ রাস্তায় নেমে আসলো, শেখ মুজিবের এবং তার গোষ্ঠীর ভাস্কর্য ও স্থাপনা ভেঙে দিল, কেন এমন হলো সেই প্রশ্নের জবাব তাদের খুঁজতে হবে। প্রশ্ন করার আগে ভালো-মন্দ খুঁজলে হবে না। এখানকার মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণি প্রশ্ন করার আগে ভালো-মন্দ বিচার করতে নেমে যায়। এতোদিন যারা ইতিহাস লিখেছে, তারা ফ্যাক্ট চেকেও ভয় পায়, আসলে ফ্যাক্ট একটা বিষয়, যেখানে গেলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এখানে ঘটনা চাপা দেয়া হয়। মিথ্যাকে সামনে আনা হয়েছে।

তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমরা যে শোষণ নির্যাতনের মধ্যে রয়েছি, তার ভিত্তি রচিত হয়েছে ১৯৭২ সালে। ৭২ সালে আওয়ামী শাসনে দুর্নীতি, লুটপাট, চোরাচালানি শুরু হয়, তখন ইন্ডাস্ট্রি হয়নি। লুটপাট করে টাকাওয়ালা শ্রেণি তৈরি হলো। সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি শ্রেণির লোকদের হাতে কোটি কোটি টাকা আসলো, আর সেই শ্রেণিটাই বিকশিত হলো। এরাই সংসদে যাচ্ছে। শাসন কর্তৃত্ব এদের হাতেই। শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার এই শ্রেণিতো রয়ে গেছে। এখনো তাদের আওতার বাইরে কিছু হচ্ছে না। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর এখন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, কিন্তু হাসিনার রেখে যাওয়া লুটেরা শ্রেণি এখনও তো সক্রিয় রয়েছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button