বর্তমান যুগ ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগ। ডিজিটাল এই প্রযুক্তির যুগে বিকাশ হচ্ছে ডিজিটাল অর্থনীতির। আর এই ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশের যুগে নতুন মুদ্রা রূপে আবির্ভূত হয়েছে উপাত্ত তথা ডেটা। ফলে কর্তৃপক্ষ এখন নজর দিচ্ছে উপাত্ত সুরক্ষা আইনের উপর। কিন্তু এই আইনের মাধ্যমে উপাত্তের সুরক্ষা দিতে গিয়ে তা যেন নিয়ন্ত্রণ না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখাও জরুরি।
রবিবার ‘অনলাইন স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশে ব্যবসা ও বিনিয়োগ’ শীর্ষক এক প্যানেল আলোচনায় বিষয়টি উঠে এসেছে।
রাজধানীর ইএমকে সেন্টারে ওই আলোচনার আয়োজন করা হয়। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের ফেসবুক পেজে তা সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
আলোচনায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, উন্নয়ন ও নিরাপত্তা কোনোভাবেই গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের ঊর্ধ্বে স্থান পেতে পারে না। এ মূল্যবোধগুলো আসলে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং একে অন্যকে শক্তিশালী করে। মানবাধিকারের সুরক্ষা এবং গণতন্ত্র সমুন্নত রাখা একটি দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী ও টেকসই করে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমৃদ্ধি নিয়ে আসে।
তিনি বলেন, ব্যবসাকে আকর্ষণ করার জন্য উদ্ভাবনের সংস্কৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এ জন্য অনলাইন উন্মুক্ত ও স্বাধীন হওয়া দরকার। আর সেই সূত্রে পরবর্তী যে বিষয়টি আলোচনায় চলে আসে সেটা হলো- মানবাধিকার। যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহারকারী ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার জন্য অনলাইন বিষয়বস্তু পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে এবং এটি কোনো সহজ কাজ নয়। তবে আমরা অনলাইন প্ল্যাটফরমের যে খসড়া আইন দেখেছি সেখানে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে এমন অনলাইন কনটেন্ট বা বিষয়বস্তুর সংজ্ঞার বিস্তৃত পরিসর নিয়ে আমাদের উদ্বেগ রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা সাম্প্রতিক ঘোষণার বিষয়ে উদ্বিগ্ন যে, ১৯১টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ব্লক করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
সমালোচনা গ্রহণ করার সক্ষমতা এবং অপ্রীতিকর বক্তব্য হলেও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা শক্তিশালী গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস নাগরিক সমাজের অনেক সংস্থা এবং সাংবাদিকদের কাছ থেকে এই আইন বিষয়ে শুনেছে। তাদের ভয় হলো এই নিয়ম ও আইন মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতাকে সীমিত করবে। ডেটা সুরক্ষা আইনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, আমরা উদ্বিগ্ন যে ডেটা সুরক্ষা আইন যদি ডেটা স্থানীয়করণের প্রয়োজনীয়তাকে কঠোরভাবে অনুসরণ করার শর্ত দিয়ে অনুমোদন করা হয় (আইনে পরিণত করা হয়) তাহলে বর্তমানে বাংলাদেশে কাজ করছে এমন কিছু আমেরিকান কোম্পানি বাংলাদেশের বাজার ছেড়ে যেতে বাধ্য হতে পারে। একইভাবে অনলাইন প্ল্যাটফরম পরিচালনার ক্ষেত্রে যদি কোম্পানিগুলোকে ব্যবহারকারীদের তৈরি করা কনটেন্ট বা বিষয়বস্তুর কারণে অপরাধের দায় নিয়ে ফৌজদারি আইনের মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে তারা এখানে তাদের ব্যবসায় বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থাকবে। এর পরিণতি বাংলাদেশের জন্য খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। প্রায় ২০০০-এরও বেশি স্টার্টআপকে ব্যবসা ছেড়ে দিতে হতে পারে এবং প্রতিদিন যে কোটি কোটি বাংলাদেশি ব্যবহারকারী তাদের সেবা নিচ্ছেন তারা আর এই সেবাগুলো পাবেন না।
ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসন বলেন, ডিজিটাল অর্থনীতির যে বিবর্তন হয়েছে, তাতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে নিষ্পেষণের সুযোগ নেই। ডেটা সুরক্ষা আইনের খসড়ায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়ে উদ্বেগ রয়েছে। এতে করে আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর উদ্বেগ বাড়ার আশঙ্কা আছে। তাই মানবাধিকার সমুন্নত রেখে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার স্বার্থে আন্তর্জাতিক মান অক্ষুণ্ন রেখে কাজটি করতে হবে। তবে বিভিন্ন পক্ষকে যুক্ত করে এ আইনের খসড়া নিয়ে যে আলোচনা তা আশাব্যঞ্জক।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, খসড়া আইনে বিভিন্ন ধারণা নিয়ে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। ব্যক্তিগত ডেটা বলতে কী বলা হচ্ছে, তা সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। গোপনীয়তা এবং ব্যক্তির অধিকারের ক্ষেত্রেও ধারণাটা স্পষ্ট নয়। ডেটার স্থানীয়করণের ক্ষেত্রে ব্যবসার কোনো স্বচ্ছতা নেই এবং এর প্রভাবই স্পষ্ট নয়। আর এ ধরনের আইন কার্যকরের ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন কমিশনের অপরিহার্যতা থাকলেও এখানে তা নেই। ফলে সামগ্রিকভাবে ডেটা সুরক্ষার নামে তা যেন নিয়ন্ত্রণ না হয়, এ আশঙ্কা রয়েছে। সামগ্রিকভাবে সরকারকে এখানে এতটা ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যে এটা নজরদারির জন্য প্রয়োগ হতে পারে।
কম্পিউটার সফটওয়্যার নির্মাতা মার্কিন প্রতিষ্ঠান ওরাকলের এদেশীয় ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবাবা দৌলা বলেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কালে ডেটাকে নতুন মুদ্রা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রতিদিন যে ডেটা তৈরি হচ্ছে, তার মজুত অপ্রত্যাশিত হারে বেড়ে চলেছে। অনলাইনের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলাটা ডিজিটাল অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ডেটা সুরক্ষা আইন যেন প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করে, সে আহ্বান জানিয়ে রুবাবা দৌলা বলেন, আইসিটি রফতানি ২০০৮ সালের ২৫ মিলিয়ন থেকে ২০২১ সালে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার হয়েছে। চার গুণ হয়ে ২০২৫–এ ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। এ প্রবৃদ্ধি কীভাবে হবে, যদি প্রতিবন্ধকতা দেওয়া হয়?
আলোচনায় অন্যান্যের মধ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এদেশীয় পরিচালক টুমো পোটিআইনেন অংশ নেন।